আগামী মাসে বাজেট ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। বাজেটের আকার হতে পারে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ৭৪ হাজার তিন কোটি টাকা বেশি।
করোনাভাইরাস, ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশে দুর্নীতি- এই তিনটি বিষয় সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চেপে ধরেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জিডিপির ভালো প্রবৃদ্ধি সাধারণ নাগরিকদের স্বস্তি দিচ্ছে না। কিন্তু কেন?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটকে এক বছরের সাধারণ আয়-ব্যয়ের হিসাব হিসেবে দেখলে চলবে না। বাজেট বাস্তবায়ন নীতি স্পষ্ট থাকা দরকার, আর দরকার দুর্নীতি প্রতিরোধ, অর্থপাচার রোধ এবং প্রবৃদ্ধির সুফল যেন সবাই পায় তার জন্য নীতি নির্ধারণ।
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকনোমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, “প্রবৃদ্ধি হলে, মানুষের আয় বাড়লে ট্যাক্স আদায়ও তো বাড়বে। সেটা তো বাড়ছে না। তাহলে যাদের আয় সত্যিকার অর্থেই বাড়ছে তারা কি ট্যাক্স দিচ্ছেন? তারা যদি ট্যাক্স দিতেন তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য সরকার তা কাজে লাগাতে পারত।”
তার কথা, “দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এটা বৈশ্বিক প্রভাব ছাড়াও অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ব্যবস্থার অভাবের কারণে প্রকট হয়েছে। আর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গরিব মানুষের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেটা কি তারা ঠিকমত পাচ্ছেন?”
এবারের বাজেটে রাজস্ব আয় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ধরা হতে পারে। ঘাটতির পরিমাণ হতে পারে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। বাজেটে ভর্তুকি এবং প্রণোদনা বাড়তে পারে। এই দুই খাতে বরাদ্দ থাকতে পারে ৭২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ১৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা বেশি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ, সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ঘাটতি বাজেটে অর্থের সংস্থানই এবারের বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন। তিনি আরও যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলেন তার মধ্যে রয়েছে- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতি, অপচয় এবং দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে সংকট।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, “বেসরকারি খাতে এখন যা অবস্থা তাতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। আর সেটা যদি হয় তাহলে কর্মসংস্থানের সংকট তৈরি হবে। করোনাভাইরাসে অনেকে কাজ হারিয়েছেন, অনেকের আয় কমে গেছে তাই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।”
তিনি বলেন, “সরকার নিজেই এখন খরচ কমানোর কথা বলছে। এটা করতে হলে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। গত বাজেটে দেখেছি ৩২টি প্রকল্প আছে যার প্রতিটির জন্য বরাদ্দ মাত্র এক লাখ টাকা করে। এই ধরনের প্রকল্প নেওয়াই হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না।”
“সরকারের পরিচালন ব্যয়ে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হবে। অর্থপাচার বন্ধ করতে পারলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। এখন দেখা যাক সরকার সেটাকে কীভাবে লাগাম টেনে ধরে,” বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, “সাধারণ মানুষ এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যে চরম সংকটে আছে তা থেকে তাদের মুক্তি দিতে না পারলে আরও সংকট তৈরি হবে। তাই বাজার মনিটরিং-এ সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারকে টিসিবির কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে তেলসহ আরও অনেক ভোগ্যপণ্য আমদানি করা যেতে পারে। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আর সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তায় আরও বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, এটা যারা প্রাপ্য তারা যেন পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।”
তার কথা, “ইনফ্লেশন কমানো একটা কৌশলগত ব্যাপার। এটা কমালে আবার সুদের হার বাড়বে। তখন উৎপাদন ও কর্মস্থানে প্রভাব পড়ে। এই দুইটির একটা ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। আমদানি ব্যয় কমাতে হবে। আর স্বল্প মেয়াদে হলেও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।”
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের সময় রিজার্ভ বেড়েছিল। কিন্তু এখন রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। কোভিডের সময় রেমিট্যান্স ভালোই এসেছে। আবার আমদানি কম হয়েছে। কিন্তু এখন তো আমদানি বেড়ে গেছে। আমরা তখনই বলেছিলাম যে এই অবস্থা থাকবে না। এখন কোভিড রিকভারির সময়। তাই চাপ পড়ছে। বাজেটে এই চাপ থেকে বের হওয়ার একটা কৌশল থাকতে হবে।”
আর বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় এখন দুর্নীতি বন্ধ ও রাজস্ব আদায়ে জিরো টলারেন্সে যেতে হবে। শুধু টার্গেট দিয়ে লাভ হবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারকরা পলিসি নির্ধারণে কতটা আন্তরিক হবেন তা নিয়ে ড. নাজনীন আহমেদ সন্দেহ পোষণ করেছেন।
এই দুই অর্থনীতিবিদের মতে, অর্থনীতির এখন নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। তাই পরিকল্পনা অনেক সুচিন্তিত হওয়া প্রয়োজন। মাথায় থাকতে হবে সাধারণ মানুষের স্বস্তি। তাদের জীবনযাত্রার খরচ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। তাদের যদি স্বস্তি দেওয়া যায় তাহলেই বাজেট সফল হবে বলে মনে করেন তারা।