Tuesday, May 20, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

বৈশ্বিক মন্দার কারণে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ

নীতিনির্ধারকরা চলমান মুদ্রাস্ফীতি ও বিদ্যুৎ সংকটকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে বৈশ্বিক মন্দার কঠোর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে

আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২২, ০১:৫১ পিএম

বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অন্যান্য অর্থনৈতিক ফোরাম এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে।

নীতিনির্ধারকরা চলমান এই মূল্যস্ফীতি ও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান না করলে বাংলাদেশে মন্দার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন,“মন্দার সময় আমাদের অর্থনীতিতে দুটি প্রধান প্রভাব হবে- অর্থপ্রদানের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করা। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সমস্যা শুরু হলেও তা এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এদিকে বিদ্যুৎ ঘাটতি আমাদের নতুন মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখনও মুদ্রানীতি সঠিকভাবে ব্যবহার করেননি। যদিও শোনা যাচ্ছে যে ঋণের হার উঠিয়ে নেওয়া হতে পারে, তবে এটি আরও আগেই করা উচিত ছিল।“

যদিও আমাদের অর্থনীতিতে মন্দার কোনো সঠিক পরিমাপ নেই, তবুও আইএমএফের সাবেক বিভাগীয় প্রধান মনে করেন যে বাংলাদেশ মন্দায় পড়বে না, তবে আমাদের উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি মন্থর হবে।

দেশে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পরামর্শদাতা জাহিদ হোসেন বলেন, “আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মন্দার জন্য কোনো পরিমাপ নেই। তবে উন্নত দেশগুলোতে পরপর দুই ত্রৈমাসিকে জিডিপিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকলে তা মন্দা হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতি ত্রৈমাসিকে (৩ মাসে) এই পরিমাপ করা হয় না।” 

তিনি বলেন,“পণ্যের দাম বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি মন্দায় পরিণত হয়, কারণ তখন আপনাকে ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলতে হবে। একদিকে যেমন আপনার সঞ্চয় কমছে, তেমনি ব্যাংকের তারল্যও কমবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গত কয়েক মাসের তথ্য-উপাত্ত সেটাই দেখাচ্ছে।“

জাহিদ হোসেন বলেন, "বাংলাদেশের ওপর আসন্ন মন্দার প্রভাব কমাতে নীতিনির্ধারকদের জন্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।তারা যদি এটি সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় তবে দেশে মন্দার মারাত্মক প্রভাব পড়বে।"

এই অর্থনীতিবিদ বলেন,“সরকারের পক্ষ থেকে এখনও তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়তি মাথাব্যথা হয়ে উঠছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং সুদের হার নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যদিও শোনা যাচ্ছে যে এই বিষয়ে শিগগিরই একটি সিদ্ধান্ত আসছে, ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে।”

ব্যবসায়ীরা যা বলছেন

ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মন্দা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, উত্পাদনকারী ও রপ্তানিকারক হিসেবে এটি বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কারণ তারা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপ যদি আমাদের প্রধান গন্তব্যগুলোকে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যায়, তাহলে এটি আমাদের পোশাক রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।আমরা ইতোমধ্যে রপ্তানি আয়ের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির অভিজ্ঞতা টের পেয়েছি যা আগামী মাসগুলোতে আরও খারাপ হতে পারে।" 

তিনি আরও বলেন, “ওইসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী পোশাকের আইটেম ডিজাইন করতে হবে।”

তাছাড়া, বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে সুদের হার বেশ বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

চলমান অশান্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা প্রদানের মাধ্যমেও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) সভাপতি এম শাহাদাত হোসেন বলেন, “কিছু দেশ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অস্থির পরিস্থিতি বোঝা উচিত।”

তিনি বলেন, “বৈশ্বিক অর্থনীতির স্বার্থে তাদের যুদ্ধ প্রত্যাহার করা উচিত। একটি উত্পাদনকারী দেশ হিসেবে আমরা পরিস্থিতির শিকার হতে বাধ্য।”

বিটিটিএলএমইএ সভাপতি আরও বলেন, "নতুন রপ্তানি গন্তব্য একটি সমাধান হতে পারে, তবে যখন বিশ্বব্যাপী মন্দা হবে তখন কেউ এর প্রভাবমুক্ত থাকবে না।" 

তার মতে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলো মন্দার প্রাথমিক প্রভাব কিছুটা হলেও এড়াতে পারে। তাই বাংলাদেশের উচিত তাদের কৌশল পর্যালোচনা করে সেই অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করা।

বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দা থাকলে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা খুবই কঠিন হবে। আমাদের উচ্চমূল্যের পণ্য উত্পাদনের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত, কারণ উচ্চমূল্যের পণ্যের ছোট ভলিউম উচ্চ রাজস্ব আনে।”

বিশ্বব্যাংক: ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার ঝুঁকি

গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রাস্ফীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে একযোগে সুদের হার বাড়ায়, যা ২০২৩ সালে বিশ্বকে মন্দার দিকে যেতে পারে এবং এটি উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব রেখে যাবে।

আইএমএফ: সবচেয়ে খারাপ সময় এখনও আসেনি

গত ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে যে, বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধাক্কার মুখে পড়তে যাচ্ছে।নীতিনির্ধারকরা মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে ভুলভাবে পরিচালনা করলে বিশ্বব্যাপী মন্দা পরিস্থিতি ভয়াবহ  হবে বলেও সতর্ক করেছে সংস্থাটি।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম

২৮ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক জরিপে অংশ নেন- বিশ্বের সরকারি ও বেসরকারি খাতের খ্যাতনামা ২২ অর্থনীতিবিদ। তাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জনই বলেছেন, ২০২৩ সালেই ধেয়ে আসতে পারে মন্দার ঝড়।

নেড ডেভিস

গবেষণাবৈশ্বিক মন্দার সম্ভাবনা নিরুপণের জন্য সুপরিচিত একটি সংস্থা– যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা-ভিত্তিক নেড ডেভিস রিসার্চ। তাদের গবেষণা মডেল অনুসারে, আগামী বছরে মন্দার ঝুঁকি এখন ৯৮.১%। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারিজনিত মন্দা এবং ২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর যা সর্বোচ্চ।

সরকারের নেওয়া উদ্যোগ

গত ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।

এর আগে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমি সকলকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় বাংলাদেশের জনগণকে কোনো দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে না হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদের করতে হবে।”

তিনি বলেন, “সতর্ক হওয়া, সঞ্চয় করা এবং মিতব্যায়ী ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এর পাশাপাশি খাদ্যে স্বাবলম্বী হতে উৎপাদন বাড়ান।”

গত ৬ অক্টোবর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনেও তিনি মন্দা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, “যার যেটুকু কৃষি জমি বা জলাশয় আছে, সেগুলো ব্যবহার করুন।”

সে সময় প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে তিনি অনেক দেশের নেতাদের সাথে মতবিনিময় করেছেন। যেখানে বিশ্ব নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, ২০২৩ সালে বিশ্ব আরও কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে এবং দেশগুলো মন্দার মতো গুরুতর সংকটের মুখোমুখি হতে পারে

   

About

Popular Links

x