ব্যাংক ঋণের সুদহার নয় ছয় মানে ‘ক্যাপ সিস্টেম' থেকে বেরিয়ে আসছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সে নতুন মুদ্রানীতিতে আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদহার পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়। আর এবার ভোক্তা ঋণের বেঁধে দেওয়া সুদহারও তুলে দেওয়া হচ্ছে। সেটা জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
বাংলাদেশে সুদহার আমানতের জন্য সর্বোচ্চ ৬% এবং ভোক্তা ঋণের জন্য ৯% সুদ বেঁধে দেওয়া ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক করে জানিয়েছে, সুদহার নির্ধারণ হবে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে। ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩% পর্যন্ত যোগ করা যাবে। বর্তমান ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ৬.৯৯%। ফলে এখনকার হিসাবে ঋণের সুদ হতে পারে সর্বোচ্চ ১০%। এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে “শর্ট টার্ম মুভিং এভারেজ” বা “স্মার্ট”। তবে এটাও এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা।
তারা বলছেন, সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে এটা। কিন্তু তাতেও আমানতকারীরা তেমন লাভবান হবে না। বড় ঋণগ্রহীতারাই লাভবান হবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ৯% ঋণ সুদহার তুলে দিয়ে ট্রেজারি বিল, বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার (ওয়েটেড) বিবেচনা করে প্রতি মাসে একটি রেফারেন্স রেট নির্ধারণ করে দেরে তারা। এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩% সুদ যোগ করে ঋণ সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংক। আগামী মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে। ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন করা হবে। এখন বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। ১৫ জানুয়ারি এই বছরের প্রথম ছয় মাসের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেসবাউল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “যদি দেখা যায় ছয় মাসের গড় সুদহার ১% বা নিম্নমুখী হয়েছে বা এমন একটি পর্যায়ে রয়েছে যা বাজারমুখী না, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার বুঝে সুদহার নির্ধারণ করে রেফারেন্স রেট জানিয়ে দেবে।”
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন, “ব্যাংকের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তো সেই প্র্যাকটিসের মধ্যে নাই। এখানে তো সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া। এখন ট্রেজারি বিলের সুদহারের ওপর সর্বোচ্চ ৩% ব্যাংকগুলো সুদ নিতে পারবে। ফলে এখানে সুদহার বাড়বে-কমবে। কিন্তু তাও আসলে এক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। তাই এটাকে ওপেন মার্কেট বলা যায় না। তবুও এটা মন্দের ভালো কারণ, হঠাৎ করেই মার্কেট ওপেন করে দিলে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। যা ডলারের ক্ষেত্রে হয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে করতে চায় এর মাধ্যমে মার্কেট ম্যাচিওরড হলে পরে ওপেন করা যাবে।”
তার কথা, “মার্কেট ক্যাপ করে দিয়ে শুধু বিনিয়োগকারীদের সুবিধা করে দেওয়া হয়েছিল। তারা কম সুদে ঋণ পেতেন। কিন্তু ব্যাংকে যারা আমানতকারী তাদের কোনো সুবিধা ছিল না। তারাও তো ব্যাংকের বড় স্টেক হোল্ডার। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বেস্ট প্র্যাকটিস নেই। সেটা করতে হলে সুদহার মার্কেটের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।”
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক এখন যা চাইছে তাতে খুব বেশি লাভ হবে না। ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে ব্যাংক ১০% সুদ নিলে আমানতকারীকে দেবে ৬%। আর এখন মুদ্রাস্ফীতি ৯%। এতে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে তেমন আগ্রহী হবে না। যারা বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী তারাই লাভবান হবেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন না। তাদের মাইক্রো ক্রেডিটের সুদহার তো বেশি ২৫%।”
তিনি বলেন, “এটা কোনো ওপেন সিস্টেম নয়। আইএমএফ এটাকে বলেছে ‘করিডর সিস্টেম'। এই সিস্টেমে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ম্যানিপুলেট না করে তাহলে ওপেন মার্কেটের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ঠিক আছে। এখন যদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ৯% হয় আর বাংলাদেশ ব্যাংক যদি নিলাম বন্ধ করে নিজেই কিনে নেয় তাহলো তো হবে না।”
প্রসঙ্গত, ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে অর্থ দিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ ৯% সুদহারের সীমা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সম্প্রতি ভোক্তা ঋণে সর্বোচ্চ ২% বাড়িয়ে সুদ নিতে মৌখিক নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কোনো সার্কুলার জারি করেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে পাওয়া ঋণের শর্ত ছিল সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া। সেই শর্ত পালনেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো।