ঈদকে ঘিরে ব্যস্ততম সময় পার করছেন টাঙ্গাইলের তাঁত ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা। প্রতিনিয়ত ভিড়ও বাড়ছে দেশি-বিদেশি ক্রেতা ও এজেন্টদের। তাঁত ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা বলছেন, ঈদে তাদের ব্যস্ততা অন্য সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। এ সময় তাঁতের শাড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কারিগরেরা যেমন বাড়তি মজুরি পেয়ে থাকেন তেমনি ব্যবসায়ীরাও বেশি বিক্রি হওয়ায় লাভবান হন।
টাঙ্গাইল শহরের কেন্দ্রস্থল নিরালা মোড় থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দক্ষিণে দেলদুয়ার উপজেলার বিখ্যাত পাথরাইল গ্রাম। সরেজমিনে রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুইপাশ থেকেই ভেসে আসে তাঁত বুননের খট্ খট্ শব্দ। তাঁত কারিগররা দিন-রাত পরিশ্রম করে তৈরি করছেন শাড়ি। আর সেই শাড়ি বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে দোকানে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি ক্রেতারা শাড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, নব্বই দশকের হিসেব অনুযায়ী টাঙ্গাইলের কুটির শিল্পের তাঁতগুলো তাঁতীদের বাড়ির অভ্যন্তরে বসানো হতো। এর মধ্যে ৭২% পাঁচটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত, ১১% তাঁত ছয় থেকে দশটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত, ৬% তাঁত এগারো থেকে বারোটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং অবশিষ্ট ১১% বারোটির অধিক তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত।
১৯৯২ সালের হিসেব অনুযায়ী, টাঙ্গাইল জেলায় ১ লাখের অধিক তাঁত ছিল এবং তাঁতীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার জন। ২০০৮ সালে এক লাখ ছোট বড় কারখানায় ৩৭ হাজার ২২২টি তাঁত এবং ৭০ হাজার তাঁতী ছিলেন। ২০১৩ সালের শুমারিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী টাঙ্গাইল জেলায় ওই সময়ে ৬০ হাজার তাঁত ছিল। এর মধ্যে ৮ হাজার ৩০৫ টি পিট তাঁত, ৫১ হাজার ১৪১টি চিত্তরঞ্জন তাঁত এবং ৮৯২টি পাওয়ারলোম তাঁত। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের তাঁতের সংখ্যা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৪০২টিতে।
দফায় দফায় সুঁতার দাম বৃদ্ধি, করোনাভাইরাসের কারণে এবং কারিগরের অভাবে এ শিল্প আগের অবস্থায় নেই। তারপরও রমজান মাসে তাঁতীরা নতুন করে স্বপ্ন দেখেন। ঈদকে কেন্দ্র করে শাড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। তাই ঈদের শেষ মুহূর্তে ধুম পড়ে যায় শাড়ি তৈরিতে।
তাঁতপল্লির বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে সারি-সারি গাড়ি এসে ভিড় করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছেন খুচরা ও পাইকারি ক্রেতারা। প্রবীণ তাঁতী সচীন রাজবংশী বলেন, “টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা এক সময় তুঙ্গে ছিল। নানা সমস্যার কারণে এখন সেই অবস্থা নেই। হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বানাতে বেশি সময় লাগে। সে অনুযায়ী কারিগরদের মজুরি দেওয়া যায় না। ফলে কারিগররা চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ার লোমের দিকে ঝুঁকছে।”
তাঁতপল্লীর বিক্রয় কেন্দ্রের স্বত্বাধিকারী সোরহাব হোসেন জানান, “টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির মূল ব্যবসা ঈদ-পূজাকে কেন্দ্র করে। সারা বছর ব্যবসাটাকে ধরে রাখা হয়। ঈদ বা পূজাকে ঘিরে বছরের উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি শেষ হয়। রমজান চলছে। এবারও ঈদের আগে বিক্রি বাড়বে বলে আশা করছি।”
কারিগররা জানান, তাদের প্রতি শাড়ি তৈরিতে একটা নির্দিষ্ট হারে মজুরি দেওয়া হয়। তবে দক্ষতার ওপর নির্ভর করে মজুরি কম-বেশি হয়ে থাকে।
টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও “যত্তোশ্বর অ্যান্ড কোং” এর স্বত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক বলেন, “ঈদ এলে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির কদর অন্য সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। প্রতিবছর শাড়ির ডিজাইনে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়। তাঁতের শাড়ির ডিজাইন ও গুণগত মান অনেক ভালো। এটা দেশের অন্যতম কুটির শিল্প। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।”