খুলনার চুইঝাল মাংসের কথা শুনলে জিভে পানি আসে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। চুইঝালের খ্যাতি দেশের সীমানাও পেরিয়েছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় চুইঝাল বেশ জনপ্রিয় এবং দেশের সিংহভাগ চুইঝাল এই অঞ্চলেই উৎপাদন হয়। এসব এলাকায় চুইঝালের কাণ্ড, শিকড় পাতার বোঁটা রান্নায় ব্যঞ্জন হিসেবে এবং ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে।
এই মসলাটি খাসি, গরুর মাংস, মাছ ও ডাল রান্নায়ও ব্যবহার করা যায়। আমাদের দেশে চুইঝালের ফল খাওয়া হয় না। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার কোনো কোনো দেশে এই ফল যা শুকিয়ে মসলা হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
অন্য গাছের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা চুইঝাল ভোজনরসিকদের অন্যতম প্রিয় খাবারে পরিণত হয়েছে। এটি মাটিতে লতানো ফসল হিসেবেও চাষ করা যায়। গাছের মধ্যে আম, কাঁঠাল, মেহগনি, সুপারি, শিমুল, নারিকেল, মেহগনি, কাফুলা গাছে চুইঝাল পুষ্ট হয় বেশি। সবচেয়ে ভালো মান ও স্বাদের হয় আম, কাফুলা ও কাঁঠাল গাছে বেড়ে ওঠা চুই।
বছরখানেকের মধ্যেই চুইয়ের লতা কাটা যায়। সাধারণ যত্নেই বেড়ে ওঠে এটি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই অর্থকরী মসলাজাতীয় ফসলটি চাষ করলে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
খুলনায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় এই উপাদানটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খুলনার বিখ্যাত চুইঝালের দোকান চুকনগরের আব্বাস হোটেল। রেস্টুরেন্টটির ব্যবস্থাপক আব্দুল ওহাব জানান, তাদের রেস্টুরেন্টে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসেন। বিদেশ থেকেও অনেকেই আসেন। তাদের রান্না মাংস অনেকে দেশের বাইরেও নিয়ে গেছেন।
চুইঝাল ব্যবহারে অন্য মসলার খরচ কমে
লতা ছোটোছোটো করে কেটে টুকরো করে তরকারি, ডালসহ অন্যান্য ঝালযুক্ত উপকরণ হিসেবে রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। চুইঝাল ব্যবহার করলে তরকারিতে মরিচ ব্যবহার করতে হয় না। মরিচের বিকল্প হিসেবে চুইকে ব্যবহার করা যায় অনায়াসে।
ব্যবহারকারীরা বলেন, এটি তরকারির স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। কাঁচা অবস্থায় চিবিয়েও খাওয়া যায়। চুইয়ের লতাকে শুকিয়ে গুঁড়া করেও দীর্ঘদিন রেখে ব্যবহার করা যায়।
চুইলতার শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুল-ফল সব অংশই ভেষজগুণ সম্পন্ন। চুইঝালে ০.৭% সুগন্ধি তেল রয়েছে। অ্যালকালয়েড ও পিপালারটিন আছে ৫%। তাছাড়া ৫% পোপিরন থাকে। এছাড়া পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সিজামিন, পিপলাসটেরল এসব থাকে পরিমাণ মতো। এসব উপাদান মানবদেহের জন্য খুব উপকারী।
অনেক রোগের নিরাময় চুইঝাল
চুইঝাল অনেক রোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এটি গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর, রুচি বাড়াতে এবং ক্ষুধামন্দা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ সারায়, স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে, ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করে, শারীরিক দুর্বলতা ও ব্যথা সারায়, প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা দ্রুত কমাতে সাহায্য করে এবং সর্দি-কাশি, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও রক্তস্বল্পতা দূর করে।
অর্থনীতিতে চুইঝাল
নার্সারি শিল্পে চুইঝাল দিনদিন মূল্যবান হয়ে উঠছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এরই মধ্যে চুইয়ের চারা উৎপাদন বাণিজ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় চুই প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর খুলনা বরিশাল ফরিদপুর অঞ্চলে চুইয়ের আবাদ এবং বাজার রমরমা।
শুকনো এবং কাঁচা উভয় অবস্থায় চুই বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা চুইঝাল অঞ্চল ভেদে ৭০০ থেকে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। শুকনো চুইয়ের দাম কাঁচার চেয়ে আরও ২ থেকে ৩ গুণ বেশি; শুকনো চুইঝাল বিক্রি হয় ১,৫০০ টাকা থেকে ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত। দেশে মরিচের বদলে চুইঝাল চাষের বিস্তার ঘটিয়ে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব।
খুলনার চুই দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা যদি পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেন এবং সুনজর দেন তবে চুইঝাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
এ জন্য দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা, গবেষণা, মাঠ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বহুমুখী ব্যবহারে প্রচার প্রচারণা। তবেই চুই নিয়ে আমরাও অল্প সময়ে অনেক দূর পথ পেরিয়ে যেতে পারব।