ডলার সঙ্কটে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিত্যপণ্যের মূল্য। বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশি ভোক্তারা।
২০২১ সালের আগস্টে ৪৮.১ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এখন তা কমতে কমতে ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও রিজার্ভ গণনা এবং সংজ্ঞার জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফের নির্ধারিত পদ্ধতি ও বাংলাদেশের গণনা পদ্ধতির পার্থক্যের কারণে প্রকৃত রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।
তথ্যের গোলকধাঁধায় পড়া ভোক্তাদের বিভ্রান্তিকে কাজে লাগিয়ে কিছু অনৈতিক ব্যবসায়ী নির্বিচারে দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে।
ফলে ব্যবসায়ী ও ট্রেডিং সিন্ডিকেট ‘‘ডলার সঙ্কটকে’’ মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
ভোলার চরফ্যাশনের ইলেকট্রিশিয়ান মোহাম্মদ আলম (৫০), যিনি এখন ঢাকার মগবাজার এলাকায় কর্মরত, এই চাপে পড়া মানুষের একজন। গত এক মাস ধরে, ঈদ-উল-ফিতরের পর থেকে বাড়ি গিয়ে কাজ করার জন্য অন্তত ৫০০ টাকা নিচ্ছেন, যা আগে ছিল ৩০০ টাকা।
তিনি বলেন, “আমরা ৫০০ টাকার নিচে সেবা দিতে পারি না। ডলার সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে খাবার, ওষুধ, ইউটিলিটি বিল ও আমাদের নিজস্ব খরচ বেড়েছে। কেন আমাদের পরিষেবার হারও বাড়ানো উচিত নয় কি?’’ প্রশ্ন করেন তিনি।
বাংলাদেশের ডলার সঙ্কটকে দায়ী করে প্রায় সব দোকানদাররা বেশি দাম নিচ্ছেন মন্তব্য করে তিনি নিজেও রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
জামালপুর মেলান্দহ উপজেলার রিকশাচালক একাব্বর আলী (৬০) বর্তমানে ঢাকার রামপুরা এলাকায় বসবাস করছেন, একই ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন। ঈদ-উল-ফিতরের আগে যে দূরত্বের জন্য ২০-২৫ টাকা নিতেন এখন একই দূরত্বের জন্য নিচ্ছেন ৩০-৪০ টাকা।
আলী ব্যাখ্যা করেন, তার রিকশা গ্যারেজ ডলারের সঙ্কটের কথা উল্লেখ করে রিকশা ভাড়ার জন্য দৈনিক জমা বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, “খাবার, ওষুধের দাম ও আমাদের সব বিল বেড়েছে। আমরা যদি আমাদের ভাড়া না বাড়াই, আমরা টিকে থাকতে পারব না।”
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য তিনটি ভিন্ন পরিসংখ্যান প্রদান করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের “মোট রিজার্ভ” পদ্ধতি অনুসারে, মার্চ ও এপ্রিলের জন্য এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) দায় নিষ্পত্তি করার পর ১৪ মে পর্যন্ত রিজার্ভ ২৩.৭৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এই পরিসংখ্যানে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ব্যয় করা অর্থও অন্তর্ভুক্ত।
আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতি ব্যবহার করলে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮.৩২ বিলিয়ন ডলার, যখন প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলার থেকে সামান্য কম।
বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থার মূল্যায়ন করার জন্য আইএমএফ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেখানে বিভিন্ন ঋণ দায় বাদ দেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন, “ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ, যাকে নেট রিজার্ভ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ইডিএফ থেকে ঋণের পরিশোধ এবং আইএমএফের মাধ্যমে বিশেষ হিসেবে রাখা ডলার ব্যতীত ছাড়া রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে নেট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে না।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ইউএনবিকে বলেন, “গ্রস রিজার্ভ বর্তমানে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি যা তাৎক্ষণিক ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয় না।”
“তবে তিনি মুদ্রাবাজার ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি আস্থার অভাব উল্লেখ করেছেন, যা বাংলাদেশের রিজার্ভের অস্থিতিশীলতায় অবদান রেখেছে।”
“অনিয়ন্ত্রিত অর্থপাচার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে, যা রিজার্ভ এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিতিশীলতা আনছে,” মনসুর উল্লেখ করেছেন।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হুসেন দ্রুত কমে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সাথে যুক্ত দুটি প্রধান ঝুঁকি তুলে ধরেন। এরমধ্যে রয়েছে, আমদানি করা পণ্যের জন্য ডলার পরিশোধ করতে না পারা এবং আমদানি হ্রাসের কারণে অভ্যন্তরীণ মূল্যের পরবর্তী বৃদ্ধি।