"শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক। নারী শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে শাড়ি তারই উপমা। শরীর আর পোশাকের ওই রমণীয় এলাকা বিভাজনের অনুপাত শাড়ির রচয়িতারা কি জেনে না না–জেনে খুঁজে পেয়েছিলেন, সে কথা বলা না গেলেও এর পেছনে যে গভীর সচেতন ও মুগ্ধ শিল্পবোধ কাজ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমণীয় ও অপরূপ। শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।"
গত ৩০ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রবন্ধের শুরুটা এভাবেই করেছেন 'আলোকিত মানুষ চাই' স্বপ্নের ফেরিওয়ালা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। প্রকাশের পর থেকেই 'শাড়ি' নামের এই প্রবন্ধটিকে ঘিরে শুরু হয়েছে বহু আলোচনা-সমালোচনা। চলছে বিতর্কও। অনেকে এটিকে দেখছেন নারীর সৌন্দর্যের প্রতি চরম অবমাননা হিসেবে। প্রবন্ধটিতে অত্যন্ত নগ্নভাবে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের বর্ণবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে বলেও মনে করছেন কেউ। আবার এতে বাঙালি নারীর শারীরিক উচ্চতা ও রুচিবোধ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে বলেও অনেকের কাছে মনে হয়েছে। একইসাথে, রচনাটি নিয়ে সমালোচনা বা বিতর্কের কোনও কারণই খু্ঁজে পাচ্ছেন না অনেকে।
যেমন এপ্রসঙ্গে সাংবাদিক আনিস আলমগীর নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, "এখানে সমস্যা কোথায়? মাঝখানে নারীর রূপ সৌন্দর্য বর্ণনা? তিনি তো একজন সাহিত্যিক। শিক্ষকও। আমার সরাসরি শিক্ষক ঢাকা কলেজে। একজন সাহিত্যিক নারীর রূপ-সৌন্দর্যকে যেভাবে বর্ণনা করেন আমজনতার বর্ণনা থেকে তা তো ভিন্ন হতেই পারে। নাকি শিক্ষক হয়েছেন বলে উনি নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে পারবেন না! তার বর্ণনায় কোন লাইনগুলো আপনার কাছে অশ্লীল মনে হলো? কেন মনে হলো?''
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক নিজের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, "অধ্যাপক আবু সায়ীদের লেখাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে ওনার মানসিক কোনও সমস্যা হয়েছে, এটা সুস্থ মস্তিষ্কপ্রসূত রচনা হতে পারে না। শাড়িকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে বাঙালি নারীর শরীরের গঠন তথা সামগ্রিক বাহ্যিক সৌন্দর্যময়তাকে নিয়ে উনি যেভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, সেসব ভাষা তার বলা এতদিনকার 'উচ্চমার্গীয় সাদাকথা'র সাথে মেলানো কষ্টকর। আমি ওনার সাথে জনসচেতনতামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছি, ওনার কথা সামনা-সামনি শুনেছি তাই আমার জন্য এই বৈপরীত্য মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে একথা সত্য, আমি ওনার এই সাম্প্রতিক 'ভীমরতি'তে যারপরনাই ব্যথিত হলেও ওনার ওপর থেকে শ্রদ্ধা হারাইনি। আসলে ওঁরমত একজনের লেখার বর্ণনা, বক্তব্যে এইধরনের বিষয় উঠে আসাতে আমি রীতিমত হতবাক হয়ে গিয়েছি!"
ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির লিবারেল আর্টস এন্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ডিন ফওজিয়া মান্নান আরেকটু কঠোর মনোভাব পোষণ করে বলেন, “আসলে এই বয়সে এসে একজন পুরুষের মধ্যে পারভারশন আসা বেশ স্বাভাবিক। এই অবস্থানে এসে তাদেরমধ্যে বিকৃত দৃষ্টিতে দেখার একটা প্রবণতা কাজ করে। এছাড়া তাদের নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণও অনেকখানি কমে আসায় কী বলছেন, করছেন সেবিষয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রায় থাকে না বললেই চলে। আমার ধারণা, আবু সায়ীদ এখন সেই সময় বা পর্যায়টাই পার করছেন।”
এদিকে, 'শাড়ি' নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্টি হওয়া বিতর্ক বা সমালোচনার আসলেই কোনও জোরালো ভিত্তি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, "ভিত্তি তো খোদ প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও পরিমাণই বলে দিচ্ছে যে আছে। যদি আপনার প্রশ্ন হতো "এত প্রতিক্রিয়ার কী দরকার ছিল?" তাহলে বরং বলা যেতো যে প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও পরিমাণ মুখ্যত ইন্টারফেইসের কারণে। সাইবার পরিমণ্ডলে প্রতিক্রিয়ার বহুগুণিকতা তৈরি করে।বিশেষ করে এবারের প্রতিক্রিয়া গুণগতভাবে স্বতন্ত্র। নারীবাদী হিসেবে নানান চর্চার মানুষজন তো বটেই, নারীবাদী পরিচয়ে স্বচ্ছন্দ নন এমন বহু নারীও এ যাত্রায় অধ্যাপক সায়ীদের এই রচনায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
অধ্যাপক সায়ীদ বৃদ্ধ। বৃদ্ধদের ছাড় দিয়ে দেখার একটা প্রচলন আছে। কিন্তু বৌদ্ধিক দুনিয়ায় সেটা খুব কঠিন, বিশেষত বাণী সম্প্রচার করা থেকে অবসর নেননি যাঁরা তাঁদেরকে।"
এপ্রসঙ্গে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা ট্রিবিউন’কে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে স্যার দেশের বাইরে আছেন।” এছাড়া, অন্যকোনভাবে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে কিনা জানতে চাইলে, তা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
আবহমানকাল জুড়েই বাঙালি নারী শাড়িতে অভ্যস্ত। দেশের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রীসভার নারীসদস্যসহ প্রথিতযশাপ্রায় সকল বাঙালি নারীকেই দেখা যায় দেশে-বিদেশে নিয়মিতভাবে শাড়ি পরতে। এমনকী, ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া নারীদেরকেও শাড়ি পরেই সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে।
সময়ের সঙ্গে অন্যান্য অনেক পোশাক পরলেও এখনো শাড়িই বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক।তবে, দেশের বুদ্ধিজীবী পর্যায়ের বিশেষ কারো কাছ থেকে আসা কোনধরনের বিতর্ক-উদ্রেককারী মন্তব্য সেক্ষেত্রে অনেকের মনেই প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।