ঘুরতে ভাল লাগে না এমন মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন। ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের জন্য ভ্রমনের অন্যতম স্থান হতে পারে বালিয়া মসজিদ বা ছোট বালিয়া জামে মসজিদ। মসজিদটির নির্মাণশৈলীতে মোঘল স্থাপত্যের নান্দনিকতা পর্যটকদের যেমন বিমোহিত করে, তেমনি তুলে ধরে ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্যকে।
ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে পঞ্চগড় এর বোদা উপজেলা যাওয়ার পথে ভূল্লী হাট নামক জায়গা থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ভুল্লি-পাঁচপীর হাট সড়কের পাশে ছোট বালিয়া জামে মসজিদ অবস্থিত ।স্থানীয় জমিদার গুলমতি চৌধুরানী এই মসজিদের নির্মাতা। যদিও বিবি গুলমতি চৌধুরানীর নামেই ছিল জমিদারি।
কিন্তু কার্যত এলাকা শাসন করতেন তার স্বামী মেহের বক্স। তিনিই মসজিদটি নির্মাণ শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৮ বছর। মসজিদের গায়ে খোদাই করা তারিখ অনুসারে এটি তৈরি হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে।
প্রচলিত রয়েছে, কোন এক অমাবস্যার রাতে জিন-পরিরা এই এলাকা উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এলাকাটি পছন্দ করে । তারপর তারা মাটিতে নেমে এসে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে, কিন্তু গম্বুজ তৈরির আগেই ভোর হয়ে যাওয়াতে কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায়। ফলে গম্বুজ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকে অসাধারণ কারুকার্যময় মসজিদটি । জিন-পরীরা এটি তৈরি করেছে, এইজন্য স্থানীয়দের কাছে এটি জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত ।
ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে উত্তর দিকে পঞ্চগড় মহাসড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই ভুল্লিবাজার। বাজার থেকে ডান দিকে তিন কিলোমিটার দূরে বালিয়া গ্রাম। সরু পাকা রাস্তা দুই পাশে ঘন গাছপালা যেন সবুজের রাজ্যের প্রবেশধার। আর একটু সামনে তাকালেই মনে হবে যেন মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনসমৃদ্ধ কোনো এলাকায়। গাছগাছালিঘেরা লালচে স্থাপনা। উঁচু গম্বুজ উঁকি দিচ্ছে। ছায়ামাখা শান্ত পরিবেশ।
সদর দরজা, খোলা চত্বর আর মূল দালান তথা নামাজঘর—এই তিন অংশ নিয়েই মসজিদ কমপ্লেক্স। ঢাকায় বিভিন্ন মোগল স্থাপনাগুলোর সঙ্গে বেশ মিল। মসজিদে কোনো পিলার নেই। একটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এটি। মসজিদের ভিত্তি পর্যন্ত এই প্রশস্ততা বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মের দেয়াল একেবারে নিচের দিকে ৭৪ ইঞ্চি চওড়া। মাটির নিচে সেটি আরো বেশি। আয়তাকার এই মসজিদ উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আর পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি দীর্ঘ। মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত। প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। মসজিদটিতে হাতে তৈরি ইটের সঙ্গে চুন-সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। লালচে ইট কেটে তৈরি করা হয়েছে নানা রকমের নকশা। অলংকৃত নকশাগুলো ঘণ্টা, আমলকী, কলস-বাটি ও পদ্মাকৃতির। যা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা। দেয়ালে কোনো রকমের আস্তরণ নেই। সেই পুরোনো অবয়বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওপরে তৈরি করা হয়েছে তিনটি সুউচ্চ গম্বুজ। মসজিদের প্রধান ফটকের দৈর্ঘ্য ২১ ফুট, প্রস্থ ৯ ফুট। বিশাল আকৃতির সদর দরজাটিই মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এরকম ফটকওয়ালা মসজিদ এই অঞ্চলে চোখে পড়ে না। সময়ের পরিক্রমায় মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালে মসজিদটি আগের স্থাপত্যরীতির সাথে মিল রেখে আবার পুনর্নির্মাণ করা হয়।
আরও কিছু তথ্য: বালিয়ার পাশেই মলানি গ্রামে রয়েছে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বসবাস। শীতে সাঁওতালদের অনেক রকম উৎসব থাকে। শীতকালে ঠাকুরগাঁওয়ের আরেক আকর্ষণ কাঞ্চনজংঘা দর্শন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বুড়ির বাঁধ এলাকা থেকে খালি চোখে কাঞ্চনজংঘা চোখে পড়ে।
কীভাবে যাবেন: ঢাকার শ্যামলী, গাবতলী থেকে একঘণ্টা পর পরই ঠাকুরগাঁওয়ের কোচ ছাড়ে। ঠাকুরগাঁও পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। এসি গাড়িতে খরচ পড়বে ১১০০-১২০০ টাকা আর নন-এসিতে ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। এছাড়া দিনাজপুরগামী আন্তনগর ট্রেন একতা, দ্রুতযান ও নীলসাগর এক্সপ্রেসে সৈয়দপুরে নামতে পারেন। সেখান থেকে বাসে করে ঠাকুরগাঁও। পুরোনো বাসস্ট্যান্ড থেকে পঞ্চগড়গামী বাস কিংবা অটোরিকশায় ভুল্লিবাজার হয়ে বালিয়ায় যাওয়া যায়।