বিমান থেকে এডিনবার্গে নেমে প্রথম যে অনুভূতি কাজ করছিল তা হলো- এই ফ্লাইটেই কি বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া যাবে কোনোভাবে?! প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে ৫ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এডিনবার্গে পড়তে আসার অনুভূতি বিফল হয়ে যাচ্ছিল। তখনও কি আমি জানি, পরবর্তী ৩৬৫ দিনের মধ্যেই এই এডিনবার্গ নামের শহরটি আমার অন্যতম একটি পছন্দের শহরের খাতায় নাম লেখাবে?
যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য ক্যাসেল রক (পাথর কেটে বানানো দূর্গ) বিশেষ উপযোগী জায়গা হওয়ায় ৭ম শতাব্দীতে ব্রিটিশরা শহরটির গোড়াপত্তন করে। তখন একে ডাকা হতো এইডেন্’স বার্গ Eiden’s Burg (বার্গ অর্থ দূর্গ)। এভাবে ১৫ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রিটিশ আর স্কটিশদের মাঝে বেশ কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়, আর এরই মধ্যে এডিনবার্গ একটি দূর্গ নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে, যা পরবর্তীতে স্কটল্যান্ডের রাজধানী হিসেবে মনোনীত হয়।
স্কুল অব কেমিস্ট্রি, ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ। ছবি: সৌজন্যএকবিংশ শতাব্দীতে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গে পড়তে এসে জানলাম এডিনবার্গ এর সংক্ষিপ্ত নাম "এডিনব্রা"। স্কটিশরা আসলে ব্রিটিশদেরও একধাপ ওপরে, কারণ স্কটিশ ভাষা অর্থাৎ ধরণ বা এক্সেন্ট বুঝতে ব্রিটিশদেরও বেগ পেতে হয়। অনেক ভেবেচিন্তে শেষে এটাই বুঝেছিলাম যে, এডিনবার্গের এডিন পর্যন্তই এরা ঠিকঠাক বলে, বাকিটা যে যার সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ দিয়ে পার করে দেয়।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৫৮২ এবং কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে এ বছর ২০তম অবস্থানে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ। ছবি: সৌজন্যএডিনবার্গের ডাকনাম হলো "এথেন্স অব নর্থ"। দ্যা এইজ অব এনলাইটমেন্ট (Age of enlightment) থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত শহরটিকে একটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিণত করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনন্য। এতসব মহামনীষী, বিজ্ঞানী, চিত্রকর, লেখকের উত্থান এই শহরকে ঘিরে যে, এর প্রতিটি অলিগলি যেন একেকটি গল্পকে ধারণ করে।
ব্যাগপাইপার। ছবি: সৌজন্যকথাবার্তা, পোশাক আর সংস্কৃতিতে এদেরকে ঠিক যতটাই উদ্ভট মনে হোক না কেন, স্বভাবে এরা ঠিক ততোটাই শান্তিপ্রিয়, অমায়িক আর বন্ধুবৎসল। এডিনবার্গ সিটিতে ঢুকতেই বিশেষ করে রয়্যাল মাইল আর প্রিন্সেস স্ট্রিটে এক অদ্ভুতদর্শী ড্রেসে (যার নাম ক্লিট) কিছু মানুষকে দেখতে পাবেন ব্যাগপাইপ (বিশেষ ধরণের বাঁশি) বাজাচ্ছে। একদম স্কটিশ বা হাইল্যান্ড মিউজিকের স্বাদ পাবেন। সিটিতে ঢুকতেই যেন শহরটার নতুন এক রূপ ধরা পড়ে। চারদিকে যেন ট্যুরিস্ট মৌসুম চলছে। বিকেলের আলতো আলোয় এর রাজকীয় রূপটা মনে দাগ কাটতে বাধ্য। সাদা আর কালোয় মেশানো একেকটা এন্টিক আর্কিটেকচার আপনাকে এর ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়ে ভাবাবে নিঃসন্দেহে।
আমার বাসাটা ছিল শহর থেকে একটু ভেতরের দিকে। একদম ছিমছাম, ছবির মতো সুন্দর। দূর থেকে একটা পাহাড় দেখা যেত। আর্থার সিট, কিং আর্থারের নামে যার নামকরণ বলে ধারণা করা হয়।
আর্থার সিট। ছবি: সৌজন্যপাহাড়ে চড়ার নেশা চেপে বসল একদিন। ৭ দিনের মাথায় একদল মালয়েশিয়ান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উঠে গেলাম চূড়ায়। ৮২২ ফিট উঁচু এই পাহাড় ঘেঁষে আছে হলি রোড পার্ক, দানসেপি লেক, সেলিসবেরি ক্রেইগ যেখানে সাদা সোয়াইনরা খেলা করে। বিলুপ্ত এই ভল্কানকে রবার্ট লুই স্টিভেনসন বলেছেন, ‘‘A hill for magnitude; A mountain in virtue of its bold design!!’’
সেদিনের সেই প্যানারমিক ভিউ এখনও চোখে লেগে আছে। সামনে নর্থ সি শোর, পেছনে অবারিত সবুজ পাহার, দূরে বিন্দু বিন্দু এডিনবার্গ সিটি ঝলমল করছে সকালের শুভ্র আলোয়, আর কানে বাজছে মৌসুমী ভৌমিকের গান- "আমি শুনেছি সেদিন তুমি...."
দানসেপি লেক, এডিনবার্গ। ছবি: সৌজন্য
ফারজানা আফরোজ, প্রভাষক, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (সাবেক শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ)