পেন্সিলের গ্রাফাইট দিয়ে ক্ষুদে ভাস্কর্য গড়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের তরুণ ভাস্কর কুতুবুল ইসলাম অভি। অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের আয়োজিত প্রদর্শনীর ‘বৃহত্ত’ শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রথম নজরে আসেন তিনি। ‘বৃহত্ত’ প্রদর্শনীটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিশ্বজিৎ গোস্বামী।
১৮তম এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে শোভা পেয়েছে পেন্সিলের গ্রাফাইট দিয়ে অভির তৈরি ১৩টি ক্ষুদে ভাস্কর্য ‘বিন্দু বিসর্গ’। নিজের সাম্প্রতিক এই শিল্পকর্ম প্রসঙ্গে ঢাকা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন তরুণ ভাস্কর কুতুবুল ইসলাম অভি।
শিল্পের প্রতি আগ্রহ কীভাবে সৃষ্টি হলো? কবে থেকে ভাস্কর্য তৈরি শুরু করলেন?
শিল্পের প্রতি ভালো লাগা ঠিক কবে থেকে সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়টি মনে করাটা কষ্টকর। যতোদূর মনে পড়ে, বেশ ছোটবেলা থেকেই এ বিষয়ে আগ্রহ ছিল। সম্ভবত স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে যখন ভাস্কর্য তৈরির কাজ শুরু করি, তখন সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। যদিও আমার বাসায় সুনির্দিষ্ট কোনো শিল্পচর্চার প্রচলন ছিলো না।
প্রথমে আঁকার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করলেও, প্রথম ভাস্কর্য নির্মাণের পর বুঝতে পারি, আমার আগ্রহের কেন্দ্রটা আসলে এই বিষয়ে। বুঝতে পারি, শুধু এই মাধ্যমেই আমার কল্পনাশক্তিকে তিন মাত্রায় প্রকাশ করা সম্ভব।
কীভাবে পরিবারকে রাজি করালেন যে আপনি এ বিষয় নিয়ে পড়তে আগ্রহী, যেখানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ পরিবারই নিজ সন্তানকে এই বিষয়ে পড়াতে আগ্রহী নন?
কলেজের প্রথম বছরে এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারি আমার আগ্রহের বিষয়টি নিয়ে পড়ার মতো একটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে আমি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের জন্য আসি। বাসায় জানিয়েছিলাম, বিবিএ-তে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করছি, কিন্তু আসলে আমি চারুকলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিংয়ের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বিষয়টি জানার পর, পরিবারের তরফ থেকে চাপ এসেছে, কিন্তু আমি নিজ সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। একটি পর্যায়ে পরিবারের কাছ থেকে সড়ে এসে আমার চাচার বাসায় থাকা শুরু করি। তার কাছ থেকে টাকা ধার করে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা)-এর চারুকলা বিভাগে পড়া শুরু করি।
বাবা অনেকদিন রাগ করে থাকলেও, একটি পর্যায়ে এসে বিষয়টি বুঝতে পারেন। আমাকে জানান, স্নাতক শেষ হওয়া পর্যন্ত খরচ দেওয়া হবে, এরপর নিজের রাস্তা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু, সে সময় আমার স্নাতক শেষ হতে আর মাস দুয়েক বাকি!
চারুকলা অনুষদে পড়ার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে কিছু বলুন?
ইউডা-এর চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর গতানুগতিক পাঠ্যক্রম অনুসরণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আমি ভাস্কর্য নির্মাণের উপর আরও শিখতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভাস্কর্য কেন্দ্রিক কোনো বিষয় ছিল না। এরপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জন্য চেষ্টা করি। সেখানে চান্স পাওয়া মাত্র খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই। চারুকলার ব্যাপারে যেমনটা ভেবেছিলাম, বাস্তবে দেখলাম বিষয়টা অনেকটাই ভিন্ন। ভেবেছিলাম চারুকলার শিক্ষার্থীরা শিল্প নিয়ে আলোচনা করবে, কিন্তু তা হয়নি। উল্টো প্রথম বর্ষে রযাু গিংয়ের শিকার হয়েছিলাম।
বড় ভাইদের কাছ থেকে যেমন সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছিলাম, তা পাইনি। ভুল প্রত্যাশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম চারুকলার শিক্ষার্থীরা বস্তুবাদী কম হবেন, আরও স্বচ্ছ্ব হবেন। হয়তো, আমার প্রত্যাশা ভুল ছিলো। তারা আর দশটা সাধারণ শিক্ষার্থীর মতোই ছিল এবং আমি তাদেরকে অসম্মান করছি না। মনে করেছিলাম, চারুকলা অনুষদে আমার চারটি বছর শুধু শিল্পকেন্দ্রিক হবে। ভেবেছিলাম, অভিজ্ঞতা থেকে আরও ভালো কাজ করা সম্ভব হবে।
আসলে আমি বলার চেষ্টা করছি, শিল্পকে কেন্দ্র করে বড় কোনও ঘটনা আজকাল খুব কম ঘটছে এবং এ বিষয়টি আর্ট ইন্সটিটিউটগুলোর মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। আমাদেরকে শিল্প কর্মশালায় নিয়ে যাওয়া হয় না, যেখানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করতে পারবেন। প্রশ্ন করতেই পারেন, কর্মশালার কী প্রয়োজন? এর উত্তর হচ্ছে, যখন ভালো এবং দক্ষ একজন শিল্পী তার কাজ নিয়ে আসেন, তখন যে শিক্ষার্থীর বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা নেই, সে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন, আলোচনার মাধ্যমে নতুন টেকনিক শিখতে পারেন। এভাবে একজন শিক্ষার্থী নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আরও উন্নত এবং দক্ষ করে তুলতে পারেন।
এগুলো যেরকমভাবে হওয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক কম হচ্ছে বলে আমি মনে করি। এসব কারণেও একজন শিল্পী হিসেবে আমার পথচলা অনেকটাই ধীরগতির হয়ে গেছে বলে মনে করি। তারপরেও আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ তারা আমাকে ‘বৃহত্ত’ এবং ১৮তম এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল বাংলাদেশ’-এর মতো প্লাটফর্মে কাজ করার জন্য যে সময় প্রয়োজন, তা দিয়েছেন। একজন শিল্পীর জন্য এ ধরনের সহায়তা অনেক বড় ভূমিকা রাখে।
আপনি যে পরিস্থিতি জানালেন, সেখান থেকে কীভাবে ১৮তম এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল বাংলাদেশ-এর মতো প্লাটফর্মে পৌঁছালেন?
সবকিছু শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর নাগাদ। ‘বৃহত্ত’ শিল্প প্রকল্পের জন্য সিভি এবং পোর্টফোলিও জমা দিয়েছিলাম। নির্বাচিত হওয়ার পর অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রদর্শনীটির তত্ত্বাবধায়ক বিশ্বজিৎ গোস্বামী স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিই আমাকে এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমি জানি না বিশ্বজিৎ স্যার আমার শিল্পকর্মের মধ্যে কী দেখতে পেয়েছেন, আমার এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে আসার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তার।
এখন তো এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল শেষ, আপনার পরবর্তী লক্ষ্য কী?
প্রথমত শুধু আমাদের মতো তরুণ শিল্পীদের খ্যাতি বাড়ানোর জন্য এই প্রদর্শনীগুলো আয়োজিত হয় না। আমরা এগুলো করি, শিল্পবিশ্বের কোথায় বিচরণ করছি, সে বিষয়টি অনুধাবনের জন্য। নিজের কোন বিষয়টিতে দুর্বলতা রয়ে গেছে এবং কোন দিকটিকে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে সেটি বুঝার জন্য। আমরা এটি করি, শিল্পী হিসেবে আমাদের উন্নতির গতিবিধি বুঝার জন্য।
আর আমার পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে, একজন শিল্পী হিসেবে আমার চিন্তাভাবনাকে সমাজের আরও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। চিন্তাভাবনা বলতে আমি বুঝাচ্ছি, শিল্পকর্মের মাধ্যমে আমি যে বার্তাগুলো দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি আশা করব, আরও মানুষ শিল্পকর্মগুলোর মাধ্যমে যা বলতে চাই, সে বিষয়টি বুঝতে পারবে।
আর একজন বস্তুবাদী হিসেবে, স্নাতক শেষ হওয়ার পরপর দ্রুত অর্থ উপার্জনের একটি রাস্তা প্রয়োজন। কারণ আমার বিশ্বাস, শিল্প সৃষ্টির স্বার্থে শিল্পীর বেঁচে থাকাটা জরুরি। এমন কোনো কাজ যেটি করার পাশাপাশি চিন্তা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। আর প্রতিটি ভাস্কর্য তৈরির সঙ্গে অর্থের বিষয়টি জড়িত থাকে। অর্থ আয়ের সুযোগ বের না করতে পারলে, এ ধরনের ভাস্কর্য তৈরি করা সম্ভব হবে না। তবে ছবি আঁকা যে অবস্থানেই থাকি না কেন, চালিয়ে যাব।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের টোন মিনিয়েচার ইন্টারন্যাশনাল আর্ট এক্সিবিশন, হামিদুজ্জামান খানের তত্ত্বাবধানে ধাতব ব্যঞ্জনা ভাস্কর্য প্রদর্শনী ২০১৭, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ অ্যান্টি করাপশন কার্টুন কম্পিটিশন ২০১৭, রুম টু বুক রিড ইলাস্ট্রেশন প্রজেক্ট ২০১৮-এ প্রদর্শিত হয়েছে কুতুবুল ইসলাম অভির শিল্পকর্ম।