Tuesday, March 25, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

চাঁদের জমি কি আসলেই কেনা যায়?

আইনের ফাঁক গলে ডেনিস হোপ দীর্ঘদিন ধরেই চাঁদের জমি কেনাবেচার কাজ করে আসছেন

আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৪৪ পিএম

চাঁদ নিয়ে কথার কথা ও প্রবাদ-প্রবচনের কোনো শেষ নেই। কোনো কিছু নাগালের বাইরে থাকলে বলা হয়ে থাকে, “বামন হয়ে চাঁদে হাত দিও না”। আবার প্রেমিক-প্রেমিকারা ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রেম নিবেদন করতে আকাশের চাঁদ হাতে এনে দেওয়ার সংকল্প করে।

হাজার-লক্ষ-কোটি মাইল দূরের পৃথিবীবাসী যে চাঁদে হাত দিতে (পড়ুন পা রাখতে) পারে তা আজ থেকে ৫২ বছর আগেই প্রমাণ করেছিলেন নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন। 

তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি চাঁদে জমি কেনার দাবি করেছেন। আবার পুরো চাঁদ হাতে না এনে দিতে পারলেও জীবনসঙ্গিনীকে চাঁদের জমি উপহার দেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে!


আরও পড়ুন- চাঁদে জমি কেনার দাবি দুই বাংলাদেশির!


কিন্তু সত্যিই কি কারও পক্ষে চাঁদের জমি কেনা সম্ভব? উত্তর হলো- না! উত্তরের সঙ্গে সঙ্গেই আবার যে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- কেন না? কারণ আন্তর্জাতিক এই চুক্তি।

একটু পেছনে ফিরে যাই। ১৯৬৭ সালের ২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইনের ওপর ভিত্তি করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ‘‘দ্য আউটার স্পেস ট্রিটি’’ নামে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করে। 

চুক্তি অনুযায়ী, কোনো দেশই পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে চাঁদ এবং অন্যান্য বস্তুগুলোর দখল নিতে পারবে না বা নিজেদের একক সম্পত্তি হিসবে দাবি করতে পারবে না। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১১০টি দেশ এই চুক্তিতে সই করেছে। এছাড়া, সম্প্রতি আরও ২৩টি দেশ এতে সই করেছে বলে জানা যায়।


আরও পড়ুন- এবারে চাঁদে ১০ একর জমি কেনার দাবি গোপালগঞ্জের দম্পতির!


পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে চাঁদ এবং মহাশূন্যের অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘‘মুন এগ্রিমেন্ট’’ নামে এক সমঝোতা প্রস্তাব আনে জাতিসংঘ। সেই প্রস্তাবের মূল বিষয়গুলো ছিল, চাঁদ এবং মহাশূন্যের অন্যান্য বস্তুতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পরিচালিত কর্মকাণ্ড হতে হবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে এবং কোনো মহাকাশ স্টেশন বানাতে হলে আগে জাতিসংঘকে  জানাতে হবে। 

এছাড়া, চাঁদ এবং এর যে কোনো প্রাকৃতিক সম্পত্তিতে মানব সভ্যতার সবার সমান অধিকার থাকার কথাও বলা হয় ওই প্রস্তাবে।

জানা যায়, জাতিসংঘের প্রস্তাবে উল্লিখিত আইনগুলোর বাস্তবিক প্রয়োগ করা সহজ নয়। কারণ, সমর্থনকারী দেশগুলোর কাজ হবে জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবকে আইনে পরিণত করা এবং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। ফলশ্রুতিতে চাঁদ হয়ে যায় মহাসাগরের মতো, সবাই ব্যবহার করতে পারলেও মালিকানা দাবির অধিকার কারোরই নেই।


আরও পড়ুন- বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীকে ‘চাঁদের জমি’ উপহার


ফ্রান্স এবং আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ ১১টি দেশ এই প্রস্তাবে সমর্থন জানালেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন এবং রাশিয়ার মতো মহাকাশ গবেষণার প্রধান দেশগুলো এতে সমর্থন জানায়নি।

তাহলে অনেকেই যে চাঁদে জমি কিনছে? আবার চাঁদে জমির মালিকানার প্রমাণ হিসেবেও নথিপত্র পাচ্ছে সেগুলো কী? 

বিষয়টির ব্যাখায় যাওয়া যাক-

কথায় আছে, আইনের মাঝেও ফাঁক থাকে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা ১৯৬৭ সালের সেই চুক্তিটিতেও একটি ফাঁক বা খুঁত ছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র চাঁদের মালিকানা দাবি করতে পারবে না। কিন্তু কোনো সাধারণ মানুষ মালিকানা দাবি করতে পারবে কি-না সেই প্রসঙ্গে চুক্তির কোথাও কিছু উল্লেখ নেই।

চাঁদের জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে যার নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেনিস হোপ। ১৯৬৭ সালের সেই চুক্তির খুঁত নিয়ে দ্য স্পেস সেটলমেন্ট ইনস্টিটিউট তো এয়ারলাইনের আদলে “স্পেসলাইন” চালু করতে চায়। আবার অনেক ব্যক্তিও চাঁদের মালিকানা দখলে নেওয়া নিয়ে অনেক কিছু করেন। কিন্তু ১৯৬৭ সালের চুক্তির খুঁতের পূর্ণ সদ্ব্যবহার (!) যদি কেউ করে থাকেন তাহলে সেটি একমাত্র ডেনিস হোপ।

৮০'র দশকে এই মার্কিন নাগরিক চাঁদে বসতি গড়ে তোলার কথা ভাবলেন। মার্কিন আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি মালিকবিহীন সম্পদের মালিকানা দাবি করে, অন্য কোনো ব্যক্তি সে সম্পদে দাবি না রাখে এবং কোনো সরকারি কর্মকর্তার সই করাতে পারে, তাহলে সে ওই সম্পদের মালিক হয়ে যাবে।

এই আইনের সূত্র ধরে হোপ একটি দলিল তৈরি করেন এবং স্থানীয় মেয়রের অফিস থেকে তা সই করিয়ে নেন। পরে ১৯৮০ সালে চাঁদ এবং এর খনিজ সম্পদের মালিকানা দাবি করে সেই দলিলের কপি তিনি জাতিসংঘে পাঠান। জাতিসংঘের কাছ থেকে সেটির কোনো জবাব না পেলেও মার্কিন আইন অনুযায়ী ডেনিস হোপ চাঁদের মালিক হন।

চাঁদের মালিক হওয়ার পর শুধু চাঁদের মালিক হয়ে বসে না থেকে ‘‘লুনার অ্যাম্বাসি কমিশন’’ নামে একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান বানিয়ে আয় উপার্জনের পথও তৈরি করেন হোপ। তিনি পত্রিকায় চাঁদ কিংবা চাদের জমি বিক্রির বিজ্ঞাপনও দেন। চাঁদের জমি হলেও প্রতি একর জমির দাম তিনি নির্ধারণ করেন ২৪.৯৯ থেকে ৫০০ ডলারের মধ্যে, যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যেই।

ডেনিস হোপের ভাষ্যমতে, এসব জমির মালিকানা আইনত বৈধ এবং এ সংক্রান্ত আইনি দলিল, মৌজা পর্চাও রয়েছে। যদিও সাংবাদিকেরা তার কাছে চাঁদের জমির দলিল দেখতে চাইলে তিনি নিজের বানানো যে দলিলটি দেখান সেখানে অনেক বানান ও ব্যাকরণগত ভুল রয়েছে। আসল দলিল তিনি সুরক্ষিত রেখেছেন বলে দাবি করেন হোপ।

তবে আইনত ব্যাপারটি যাই হোক, তার কাছ থেকে অনেকেই মজা করে কিংবা উপহার হিসেবে চাঁদের জমি কিনেছেন। হোপের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে বিশ্বজুড়ে ৬০ লাখ মানুষ সর্বমোট ৬১১ মিলিয়ন একর জমি কিনেছে। 

ক্রেতার তালিকায় রয়েছেন জর্জ বুশ, জিমি কার্টার, রোনাল্ড রিগ্যানের মতো ৬৭৫ জন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। ১৯৯৫ সাল থেকে ডেনিস হোপের বাৎসরিক আয় ২৭ থেকে ৩০ হাজার ডলার।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদে পাস করা একটি বিলের ধারা কাজে লাগিয়েও ডেনিসের চাঁদের জমি বিক্রির কাজটি করা হচ্ছে। ওই বিলে বলা হয়, মহাকাশে আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত কোনো মার্কিন নাগরিক আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে গ্রহাণু বা মহাকাশের কোনো স্থানের মালিকানা ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের সুবিধা পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের নাগরিকরা এক্ষেত্রে চুক্তির মাধ্যমে চাঁদ বা অন্যান্য স্থানের মালিকানা সুবিধা পাবে।

তবে বিলটি মার্কিন সংসদে পাস না হওয়ায় এবং জাতিসংঘের দেওয়া প্রস্তাবের সাথে সামঞ্জস্য না থাকায় চাঁদের জমি ক্রয়-বিক্রয় দিনশেষে অবৈধ বা আইনত ভিত্তিহীনই থাকছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চাঁদে জমি বা প্লট বরাদ্দের লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করলেও এই জমির ভবিষ্যৎ স্পষ্ট নয়। 

তাছাড়া, এখন পর্যন্ত যত মানুষ যত একর চাঁদের জমি কিনেছেন বা সামনেও অনেকেই যে পরিমাণ জমি কিনবেন, তাতে চাঁদের মোট জমির পরিমাণ শেষ হয়ে গেলেও সবাইকে আদতে তাদের জমি বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না।

কাজেই টাকা খরচ করে যে কেউ হয়ত চাঁদের জমি কেনার মালিকানা দাবি করতে পারেন, কিন্তু আইনত সেই মালিকানা অবাস্তব এবং ভিত্তিহীনই থেকে যাবে।

   

About

Popular Links

x