“বাঙালি ভেতো, ঘরকুনো ও অলস,” এমন কথাই প্রচলিত বেশি। তবে তা মিথ্যা প্রমাণে সফল বাঙালির সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
আজকের দিনে মনে করা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় জন্ম নেওয়া ইতিহাস স্রষ্টা বাঙালি সাঁতারু ও আইনজীবী মিহির সেনকে। ১৯৫৮ সালের এই দিনে তিনি প্রথম এশিয়ান হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন। পরে গিনেজ বুক ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে খচিত হয় তার নাম। শুধু ইংলিশ চ্যানেল নয়, মিহির সেন হচ্ছেন একমাত্র সাঁতারু যিনি এক বছরে (১৯৬৬ সাল) পাঁচটি মহাদেশের পাঁচটি দীর্ঘ জলাশয় অতিক্রম করেন।
সংগ্রামী জীবনের জন্য স্মরণীয় মিহির সেন। ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর ডাক্তার রমেশচন্দ্র সেন ও লীলাবতী সেনের ঘরে জন্ম তার। মাত্র ৮ বছর বয়সে মায়ের উৎসাহে পড়াশোনার জন্য চলে আসেন কটক। দূরপাল্লার সাতারু হবেন এ ভাবনা ছিল না তার। ছোটবেলা থেকে আইনজীবী হওয়ার বাসনা মিহিরের। হেঁটেছেনও সে পথে। ভুবনেশ্বরের উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানেই থেমে যেতে পারতেন।
কিন্তু পণ ছিল আরও শিখবেন, আরও পড়বেন। বাধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ। উড়িষ্যার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়েক পাশে দাঁড়ান এ মেধাবীর। তার সহায়তায় ১৯৫০ সালে জাহাজে বিলেত যাত্রা। মনে ছিল অনেক স্বপ্ন। আর যাত্রাকালে হাতে ছিল একটি তৃতীয় শ্রেণির টিকিট।
বিলেতের জীবন বিলাসপূর্ণ ছিল না মিহিরের। লিংকন্স ইনে ব্যারিস্টার ডিগ্রির জন্য ভর্তি হন। ভিনদেশে টিকে থাকার সংগ্রামে রেলস্টেশনে কাজ করতেন কুলির। কিন্তু থামেনি তার পড়াশোনা। ১৯৫৪ সালে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন মিহির সেন।
সাঁতারে সংশ্লিষ্টতা ছিল না তখনও। মিহির ছাত্রাবস্থায় পত্রিকায় ইংলিশ চ্যানেলজয়ী প্রখ্যাত মার্কিন নারী সাঁতারু ফ্লোরেন্স চ্যাডউইককে নিয়ে একটি লেখা পড়েন। নিভৃতে নিজের মতো অনুশীলন করতে থাকেন দূরপাল্লার সাঁতার।
দুনিয়া মিহির সেনকে চেনে ১৯৫৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এ দিন তিনি ১৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট সাতরে ডোভার থেকে ক্যালাইস পাড়ি দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন।
মিহির ভারতে ফেরেন জাতীয় বীর হয়ে। ১৯৫৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাকে “পদ্মশ্রী” পদকে ভূষিত করেন। কিন্তু বিধি তার জন্য নির্ধারিত রেখেছিলেন আরও অনেক কিছু। তা ছিল সাঁতার, আইন পেশা ও রাজনীতিকেন্দ্রিক।
১৯৫৮ সালে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের পর ভারতে ফিরে আইন পেশায় নিয়োজিত হন মিহির সেন। কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে বর্ণবাদী প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তার দ্রোহে ঔপনিবেশিক আইন পাল্টাতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। মূলত ফৌজদারি আইন নিয়ে আদালতে লড়তেন মিহির সেন। পেশাজীবনে অর্থ ও সাফল্য আসে দু'হাত ভরে।
ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে মিহির সেনের স্বপ্ন যেন পূরণ হয় না। তার প্রতিজ্ঞাও দূরপাল্লার। পাশে দাঁড়ান ইন্দিরা গান্ধি। সহায়তা করে ভারতের নৌবাহিনী।
১৯৬৬ সাল, এই এক বছরে মিহির সেন একে একে অতিক্রম করেন পাক প্রণালী, জিব্রালটার প্রণালী, ডারডেনিলস উপসাগর,বসফোরাস প্রণালী ও পদ্মা চ্যানেল। এ কৃতিত্বে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে মিহির সেনের নাম লেখা হয়ে যায়।
১৯৬৭ সালে ইন্দিরা গান্ধি তাঁকে “পদ্মভূষণ” খেতাবে ভূষিত করেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য নানা কারণেই স্বভূমে প্রত্যাখ্যাত হন ভূবনজয়ী বাঙালিরা। মিহির সেনের জীবনের শেষ বেলায়ও তা ঘটে। ১৯৭৭ সাল থেকে কর্তৃত্বময় জ্যোতি বসুর সঙ্গে বিবাদ ঘটে। সিপিএম-এর স্বেচ্ছাচারি আচরণের বিপরীতে কিছুই করার থাকে না এই মানুষটির। মিহির সেনের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়, বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। কর্পদকশূন্য হয়ে পড়েন তিনি।
৬৬ বছর বয়সে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৭ সালের ১১ জুন পরলোকে পাড়ি জমান মিহির সেন। শুধু তার দেহটুকুই অন্তর্লীন হয় তাতে। তার কীর্তি ও দূরকে জয় করার সক্ষমতা বাঙালি মনে চিরঞ্জীব।