গর্ভকালীন অবস্থায় আমরা একজন নারীর নানান ধরনের যত্ন নিলেও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেখুব বেশ উদাসীন। একজন গর্ভবতী নারীর শারীরিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক একই রকম গুরুত্বপূর্ণ তার মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া।
আসুন জেনে নিই, গর্ভকালীন একজন নারীর কী কী মানসিক রোগের ঝুঁকি থাকতে পারে।
গর্ভকালীন একজন নারী কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগতে পারেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার মানে প্রথম ছয় মাস একজন গর্ভবতী ভুগতে পারেন উদ্বেগজনিত সমস্যায়। তিনি বেশিরভাগ সময় ভয় পেতে থাকেন নিজের ও সন্তানের সুস্থতা নিয়ে। এ সময় বিষণ্ণতা খুব বেশি দেখা যায়। গর্ভকালীন পরবর্তী সময়ে তিনি ডেলিভারি পদ্ধতি নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। এ সময় প্যানিক অ্যাটাকের ঝুঁকিও বেড়ে যায় বহুগুণে।
যে সকল মায়েরা আগে থেকেই মানসিক রোগে ভুগছিলেন গর্ভকালীন তাদের সেসব মানসিক রোগ পুনরায় ফিরে আসতে পারে। তাই সে ব্যাপারেও গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য।
বাচ্চা জন্মদানের পরপরই তিনটি মানসিক সমস্যা আমরা খুব বেশি দেখে থাকি। তা হলো- মেটার্নিটি ব্লু, পোষ্টপার্টাম ডিপ্রেশন, পোষ্টপার্টাম সাইকোসিস।
প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ গর্ভবতী নারীই মেটার্নিটি ব্লুতে ভুগে থাকেন। যা সন্তান জন্মদানের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়। এটির উপসর্গগুলো তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে তীব্র আকার ধারণ করে।
মেটার্নিটি ব্লু’র জন্য সাধারণত মানসিক রোগের ডাক্তারের কোন চিকিৎসা লাগে না। কিছুদিন পর এটি খুব ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভকালীন শরীরে যে হরমোনের পরিবর্তন হয়ে থাকে তা বাচ্চা প্রসবের পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার কারণেই এই মেটার্নিটি ব্লু হয়ে থাকে।
মেটার্নিটি ব্লু হলে একজন নতুন মা হঠাৎ করেই খুব বিষণ্ন বোধ করেন। চোখ দেখে মনে হতে পারে যে এখনই কান্না করে দিবেন, কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে বলবে যে সে ভালো আছে। এ সময় পারিবারিক ভালবাসা, যত্ন, পর্যাপ্ত ঘুম খুব জরুরি। এগুলো পেলে খুব তাড়াতাড়ি মেটার্নিটি ব্লু ভাল হয়ে যায়।
প্রতি একশ জনের মাঝে প্রায় দশ থেকে পনেরো জন নারীই সন্তান প্রসবের পর পোষ্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন। এটি সাধারণত সন্তান প্রসবের এক মাসের মধ্যে দেখা দেয়। এ সময়ে তার মধ্যে বিষণ্ণতা রোগের সকল লক্ষণ, যেমন- মন খারাপ করে থাকা, কাজে কর্মে আগ্রহ না পাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, ক্ষুধামন্দা, মনযোগের ঘাটতি, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।যাদের আগে থেকেই বিষণ্ণতা রোগ রয়েছে অথবা বংশে বিষণ্ণতা রোগ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে পোষ্টপার্টাম ডিপ্রেশন হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
পোষ্টপার্টাম ডিপ্রেশনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মত চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে পরিবারের সহমর্মিতা, যত্নসহ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ও সাইকোথেরাপির ভুমিকা অপরিসীম ।
আমরা প্রায়ই পত্রিকা অথবা খবরের কাগজ থেকে জানতে পারি যে, মা তার নবজাতক শিশুকে পানিতে ফেলে মেরে ফেলেছে, অথবা গলা টিপে হত্যা করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা ভেবে বসি একজন মা কীভাবে পারে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে। প্রকৃতপক্ষে কোনো মাই পারেন না এভাবে তার সন্তানের ক্ষতি করতে। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, বাচ্চা প্রসবের পর সেই মা পোষ্টপার্টাম সাইকোসিস নামে গুরুতর মানসিক রোগে ভুগছিলেন।
পোষ্টপার্টাম সাইকোসিস সাধারণত সন্তান প্রসবের দুই থেকে তিন দিন থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পরও শুরু হতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় পাঁচশ’ জনের মাঝে একজন গর্ভবতী মায়ের সন্তান প্রসবের পর এই রোগ হতে পারে।
আরও পড়ুন: প্রেমের কার্যকারণ
যে লক্ষণগুলো পোষ্টপার্টাম সাইকোসিস এ বেশি দেখা দেয়, তা হলো- হঠাৎ করেই ঘুম কমে যাওয়া, ক্ষুধা মন্দা, নবজাতকের প্রতি অবহেলা, চুপ হয়ে যাওয়া,কারও সঙ্গে কথা না বলে একা একা থাকা, একা একা কথা বলা বা হাসতেও দেখা যেতে পারে, অযথাই অন্যদের সন্দেহ করা। এছাড়া নবজাতকের ব্যাপারে সে অনেক নেতিবাচক কথা বলার পাশাপাশি তার মধ্যে অনেক আবাস্তব ও ভ্রান্ত বিশ্বাস দেখা যেতে পারে।
পোষ্টপার্টাম সাইকোসিস হওয়ার পর এটি যদি পর্যাপ্ত চিকিৎসার আওতায় না আনা হলে এ থেকে হতে পারে অনেক নির্মম পরিণতি। তাই শিশু জন্ম দেওয়া পর একজন মায়ের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। এতে একজন সুস্থ মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করবে একটি শিশুর সুস্থ ভবিষ্যৎ।
ডা. ফাতেমা তুজ জোহরা জ্যোতি
এমবিবিএস, বিসিএস,এমডি রেসিডেন্ট (ফেইজ বি), চাইল্ড এন্ড এডুলসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বিএসএমএমইউ।