দৃষ্টিনন্দন এক ভবন। এই ভবনের সুপরিচিতি তার গাঢ় লাল রঙের জন্য। বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পাড়ে ফরাশগঞ্জ এলাকায় এর অবস্থান। ১৯ শতকের শেষদিকে টাউন হল (তৎকালীন নর্থ ব্রুক হল) হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়। এটি নির্মাণের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকায় ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল (১৮৭২-১৮৭৬) জর্জ বারিং নর্থব্রুক। পরে এটি তার নামে নামকরণ করা হয়।
নর্থব্রুক হলের নির্মাণশৈলীতে চোখে পড়ে মুঘল ও ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণ। নদী তীর থেকে অর্ধ-গোলাকার অশ্বক্ষুরাকৃতি মিনার আর লাল রঙা ভবনটি অত্যন্ত চমৎকার দেখায়।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটির ভগ্নদশা চোখে পড়েছে। লালকুঠি তার নান্দনিক সৌন্দর্য হারিয়ে এখন হুমকির সম্মুখীন। তার টকটকে লাল রঙ এখন ফ্যাকাশে, কোথাও ময়লা, দরজা-জানালা ভেঙে জীর্ণদশা। মূল ভবনটি বহুদিন ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। হল প্রাঙ্গণ নোংরা হয়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়। সর্বত্র ময়লার ছড়াছড়ি। আর ভবন সংলগ্ন বাগানের দুর্দশা তো ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য।
তবে, বাগানে দেখা মিলবে সিটি কর্পোরেশনের কিছু সরঞ্জামাদির। সন্ধ্যা না হতেই জায়গাটিতে ভিড় জমে মাদকসেবী ও কারবারি, জুয়াড়ি, চোর-ডাকাতসহ সব ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত লোকজনের।

একসময় নর্থব্রুক হলের লাইব্রেরিতে জ্ঞান পিপাসা মেটাতেন ঢাকাবাসী। জ্ঞানের সেই আধারটিও এখন তালাবদ্ধ। বহুদিনের অবহেলা-অনিয়মের সঙ্গে নর্থব্রুক হল এলাকায় নজর পড়েছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের। ফলে জায়গাটির অবস্থা এখন গোলমেলে।
নর্থব্রুক হলের ডানদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর কার্যালয়। বাঁ দিকে বিখ্যাত ফরাশগঞ্জ ক্লাব। উল্লিখিত জায়গা দুটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। যা লালকুঠির সৌন্দর্য রক্ষার অন্তরায়।
তবে স্মরণ করা যেতে পারে ১৯২৬ সালের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা। সেবার ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য লালকুঠি তথা নর্থব্রুক হলে এক নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল।

ঐতিহাসিক এই স্থাপনার সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক দৃষ্টি প্রয়োজন। এর সংস্কারে এগিয়ে আসা উচিত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বড় সংস্থাগুলোর। এর সংস্কারের দায়িত্ব নিতে পারে আগা খান আর্কিটেকচার ফান্ড, ইস্পাহানি, ফ্রেঞ্চ কিংবা ইতালিয়ান দূতাবাসও।
২০২০ সালে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র এক জনসভায় লালকুঠিকে ঢাকার ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সেবার তিনি এর সংস্কারের ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই স্থাপনাটিকে সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু শুধু একটি সাইনবোর্ড বসিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। লালকুঠির বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট যে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই ঐতিহাসিক ভবনের ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক এসব স্থাপনা পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও সংরক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন। লালকুঠি হতে পারে শহরের অন্যতম সেরা পর্যটনকেন্দ্র। এর সংরক্ষণে এগিয়ে এসে আমাদের উচিত নিজেদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে সামনে আনতে উদ্যোগী হওয়া।