শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা

নবজাতকের জন্য মায়ের বুকের দুধ আদর্শ পুষ্টিকর খাবার। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এতে সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণ অনেক কমে যায়। মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে পরিপূর্ণভাবে। মায়ের দুধে প্রায় ২০০ উপাদান রয়েছে, যার প্রতিটি উপাদানই শিশুর জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়।

তবে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে এখনও বেশ কিছু মিথ বা ভুল ধারণা চালু আছে, যা শুনে মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ রাখেন। জাতিসংঘ বলছে, যেসব শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় না, এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাদের মৃত্যুর আশংকা যারা কেবল বুকের দুধ খায় তাদের তুলনায় ১৪ গুন বেশি। জাতিসংঘ বেতন-সহ মাতৃ-কালীন ছুটি চালু, বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য কাজের মাঝে বিরতি, এবং কর্মস্থলে বুকের দুধ খাওয়াতে মায়েদের জন্য পৃথক কক্ষের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছে।

শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র সঙ্গে কথা বলেছেন ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব লিভারপুলের ক্লিনিকাল ফার্মাকোলজি এন্ড গ্লোবাল হেলথের অধ্যাপক ক্যাটরিওনা ওয়েইট এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জেনারেল পিডিয়াট্রিক্সের অধ্যাপক অ্যালেস্টেয়ার সাটক্লিফ। চলুন জেনে নেওয়া যাক সে সম্পর্কে-

ভুল ধারণা: বুকের দুধ খাওয়ালে সাধারণত স্তনে ব্যথা এবং স্তনবৃন্তে ঘা হয়

অধ্যাপক ক্যাটরিওনা ওয়েইটের ভাষ্য, বুকের দুধ খাওয়ানোর শুরুর দিকে কিছু অস্বস্তি হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক, এবং এতে অভ্যস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত শুরুতে স্তনবৃন্তে কালশিটে পড়া কিংবা যন্ত্রণা হওয়া একদম স্বাভাবিক। কিন্তু বুকের দুধ খাওয়ানোর কারণে আসলে স্তনে ব্যথা বা যন্ত্রণা হয় না। যদি কারও এমন হয় তাহলে মনে করতে হবে স্তনবৃন্তে হয়তো কোন ইনফেকশন বা সংক্রমণ হয়েছে, অথবা এটি ঠিকভাবে শিশুর মুখে দেওয়া হচ্ছে না। শুরুতে কিছুটা অস্বস্তি হলে সেটা একেবারেই স্বাভাবিক, এবং নতুন মায়েদের এই বিষয়টার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে কারও যদি বেশ ব্যথা বা যন্ত্রণা হয়, সেটি নিয়ে ডাক্তার, নার্স বা ধাত্রীর সঙ্গে কথা বলা উচিত।

ভুল ধারণা: একেবারে শুরুতেই বুকের দুধ না খাওয়ালে পরে আর খাওয়ানো যায় না

অধ্যাপক অ্যালেস্টেয়ার সাটক্লিফ বলছেন, জন্মের পরপরই শিশুকে যদি মা স্তন্যদান শুরু করেন তার অনেক উপকারিতা আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পুষ্টি। স্তন্যদান শুরু করার আরেকটা উপকারিতা হচ্ছে এটি ইউটেরাস বা জরায়ুর সংকোচন প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করে। আর এর ফলে সন্তান প্রসব পরবর্তীকালে জরায়ুতে যে রক্তক্ষরণ হয়, সেটি থামানো বা প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া সন্তান প্রসবের পর প্রথম কয়েকদিন মায়ের শরীরে কোলোস্ট্রাম নামে প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি পদার্থ তৈরি হয়। এটি খুবই সমৃদ্ধ একটি উপাদান যা স্তন্যদান প্রক্রিয়া শুরুতে অবদান রাখে। তবে স্তন্যদানে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে কৃত্রিম বিধিনিষেধ আরোপ করার এই ব্যাপারটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অর্থাৎ একজন মা যেকোনো সময় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন।

ভুল ধারণা: বুকের দুধ খাওয়ালে কোনো ঔষধ খাওয়া যায় না

বিশ্বের যেকোন জায়গাতেই মায়েরা সাধারণত এই প্রশ্নটাই প্রথম করেন। অধ্যাপক ক্যাটরিওনা ওয়েইটের ভাষ্য, অনেক ঔষধই আসলে খুবই কম মাত্রায় শিশুর কাছে পৌঁছায়। কোনো ডাক্তার যদি বলে আপনাকে ঔষধ খেতে হবে, তখন তাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করুন। কিন্তু এমন সম্ভাবনাই বেশি যে এই ঔষধ নিরাপদে আপনি গ্রহণ করতে পারেন। একজন শিশুর আসলে সবচেয়ে বেশি দরকার একজন সুস্থ-সবল মা। সংক্রমণ, ডিপ্রেশন বা সাধারণ ব্যথা-বেদনার জন্য সাধারণত যেসব ঔষধ খেতে হয়, সেগুলো খুব সম্ভবত নিরাপদ।

তিনি জানান, স্তন্যদান করলে যেসব ঔষধ গ্রহণ করা যাবে না, সেগুলোর সংখ্যা আসলে খুবই কম। সাধারণত ক্যান্সার বা এরকম কোনো গুরুতর নির্দিষ্ট রোগের ঔষধের ক্ষেত্রে এরকমটা হতে পারে। এছাড়া কিছু ঔষধ আছে যেগুলো ব্যবহারের আগে এর ঝুঁকি এবং উপকারিতা ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখতে হয়। স্তন্য-দানকারী মাকে যখন কোনো ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, তখন তিনি যেন এই ঔষধের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কেনা যায় এমন কিছু ঔষধের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, যেমন ঠাণ্ডা বা ফ্লুর ঔষধ- কারণ এর মধ্যে এমন উপাদান থাকে যা বুকের দুধ কমিয়ে দিতে পারে। আর হারাবাল বা ভেষজ ঔষধের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।

ভুল ধারণা: কেবল সাধারণ খাবার খাওয়া উচিত এবং বুকের দুধ দেওয়ার আগে মশলাযুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত

অধ্যাপক ক্যাটরিওনা ওয়েইটের মতে স্তন্যদানের সময় খাওয়া যাবে না এরকম কোন খাবার আসলে নেই। তবে আপনার বুকের দুধে ঠিক কী পুষ্টি উপাদান থাকবে, তা নির্ভর করে আপনি কী ধরণের খাবার খাচ্ছেন তার ওপর।

তবে কিছু কিছু খাবারের বেলায় মা হয়তো একটি প্যাটার্ন দেখতে পাবেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “একটি সন্তানের বেলায় আমি খেয়াল করেছিলাম, যতবারই আমি কমলার মতো কোন টক ফলের জুস খাচ্ছি, আমার বাচ্চার মেজাজ খিটখিটে হয়ে উঠছে। আপনি কী খাবার খেলে আপনার সন্তান কিরকম আচরণ করছে সেরকম একটি প্যাটার্ন আপনি অনেক সময় খেয়াল করতে পারেন। কিন্তু আসলে এরকম কোনো খাবার নেই যেটা আপনার সন্তানের জন্য ক্ষতিকর, বা যেটা আপনার পরিহার করা উচিত।”

ভুল ধারণা: বুকের দুধ খাওয়াতে চাইলে কখনোই ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে পারবেন না

অধ্যাপক ক্যাটরিওনা ওয়েইটের ভাষ্য, এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। তবে মায়ের স্তনে কী পরিমাণ দুধ তৈরি হবে সেটা নিয়ন্ত্রিত হয় চাহিদা এবং সরবরাহের ভিত্তিতে। নারীর দেহের গঠন আসলে এত চমৎকারভাবে তৈরি যে শিশুর জন্য এটি যথেষ্ট দুধ তৈরি করতে পারে। শিশু যখন স্তনবৃন্ত চুষতে থাকে, সেটি নারীর শরীরের হরমোনকে যতটুকু দুধ দরকার, ততটুকু দুধ তৈরি করতে সংকেত দেয়। কাজেই একজন মা, তিনি একেবারেই একটি ছোট শিশু, বড় শিশু নাকি যমজ সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছেন – তার শরীরে সেই অনুপাতে যথেষ্ট দুধ তৈরি হবে।

আর শিশুকে ফর্মুলা দুধ দেওয়া শুরু করলে, নারীদেহে এই সংকেত এবং দুধ উৎপাদন চক্রে একটা ব্যাঘাত ঘটে। তখন নারীর শরীর যথেষ্ট সংকেত পায় না যে তার শিশুর আরও দুধ দরকার। কোনো মায়ের বুকে যখন যথেষ্ট দুধ আসে না, এবং তিনি শিশুকে ফর্মুলা দুধ দিতে শুরু করেন, তাতে হয়তো একটা সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যাবে, কিন্তু এর ফলে সমস্যাটা কিন্তু আরও গুরুতর রূপ নেবে।

আবার কোন নারীর যখন রাতে ঘুম হচ্ছে না, বা অসুস্থ, কিংবা ভীষণ ক্লান্ত, তখন তার সঙ্গী হয়তো শিশুকে কিছু ফর্মুলা দুধ দিচ্ছেন, যাতে করে শিশুর মা কিছুটা বিশ্রাম পান। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এই নারী আবার স্তন্যদান শুরু করতে পারবেন না। কাজেই ফর্মুলা দুধ দিলে স্তন্যদান বন্ধ হয়ে যাবে এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। তবে ফর্মুলা দুধ দিলে তা স্তন্যদানের ক্ষেত্রে খুব সহায়ক হয় না।

ভুল ধারণা : অসুস্থ অবস্থায় বুকের দুধ খাওয়ানো ঠিক নয়

অধ্যাপক অ্যালেস্টেয়ার সাটক্লিফ বলছেন, যদি কোনো নারীর এইচআইভি বা হেপাটাইটিস হয়, তখনই কেবল শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিষেধ। কারণ বুকের দুধের মাধ্যমে এসব ভাইরাস শিশুর দেহে সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া অন্য যেকোনো অসুস্থতায় মা তার শিশুকে দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে পারেন। তার ভাষ্য, এরকম ঘটনা আগে ঘটতে দেখা গেছে। মা যদি অসুস্থও থাকেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি সন্তানকে বুকের দুধ দিয়ে যেতে পারেন, কারণ মায়ের শরীরে এমন এন্টিবডি তৈরি হয়, যা সন্তানকেও সুরক্ষা দেয়। এরকম ঘটনা খুবই বিরল যে, মায়ের রোগ স্তন্যদানের মাধ্যমে তার শিশুর দেহে সংক্রমিত হয়েছে।

ভুল ধারণা: এক বছরের বেশি ধরে স্তন্যদান করলে শিশুকে দুধ ছাড়ানো কঠিন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হচ্ছে সন্তানকে ছয় মাস পর্যন্ত কেবল বুকের দুধই খাওয়ানো উচিত। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার দিলেও যতদিন ইচ্ছে বুকের দুধ চালিয়ে যাওয়া উচিত। বুকের দুধ কখন বন্ধ করতে হবে তার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যুক্তরাজ্যের মতো উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে বেশিরভাগ শিশুকেই এক হতে দুই বছর বয়সের মধ্যে বুকের দুধ দবন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে, যেমন উগান্ডায় দুই হতে তিন বছর বয়স পর্যন্ত কিন্তু শিশুকে বুকের দুধ দেওেয়া হয়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যতটা সময় ধরে শিশুকে কেবল বুকের দুধ দেওয়ার সুপারিশ করে, তত দীর্ঘ মাতৃ-কালীন ছুটি মায়েরা সাধারণত পান না। এটা সারা বিশ্বেই একটি বড় সমস্যা।