Sunday, March 23, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

সিসা দূষণে উদ্বেগজনক অবস্থায় বাংলাদেশ, ঝুঁকিতে শিশুরা

সিসা দূষণে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এই বিষাক্ত ধাতুটির কারণে দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটছে

আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ০১:২১ পিএম

ভয়ঙ্কর এক দৃশ্যের সামনে বাংলাদেশ। অজান্তেই মানুষ এক মৃত্যুকূপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তাদের ফেরাতে হবে। অন্যথায় যে শিশুরা বেড়ে উঠছে, যে শিশুরা মানবসম্পদ হওয়ার কথা- বেঁচে থাকাই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে গহ্বরের কিনারায়; ফিরতে হবে এছাড়া আর উপায় নেই।

এমন সব দৃশ্য হাজির করে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে “পিওর আর্থ” নামে একটি নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা। সংস্থাটি তিন বছরের বেশি সময় ধরে সিসাদূষণ রোধে গবেষণা ও সচেতনা তৈরির কাজ করে আসছে। বুধবার (২৫ অক্টোবর) শুরু হওয়া এই প্রদর্শনীতে সিসাদূষণের ভয়াবহতা নিয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে। এটি শেষ হচ্ছে ২৭ অক্টোবর।

আগামীর পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার দায় বর্তমানের মানুষের। কিন্তু আমরা ক্রমে সেই বাসযোগ্যতার সব মানদণ্ড ভেঙে চলেছি। ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, পানিদূষণ করে চলেছি। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছে দূষণজনিত কারণে।

সিসা নির্গত হয় এমন কারখানায় চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন বহু শ্রমিক। “পিওর আর্থ”-এর ফটো এক্সিবিশন থেকে ছবি তুলেছেন অর্বাক আদিত্য/ঢাকা ট্রিবিউন

সিসা দূষণে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এই বিষাক্ত ধাতুটির কারণে দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটছে। দেশের প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু সিসাদূষণের শিকার। যার প্রভাবে শিশুদের শরীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

“পিওর আর্থ” এই বিপর্যয়ের আঁচ অনুভব করাতে চাচ্ছে দেশের মানুষকে। ৯৭টি আলোকচিত্র নিয়ে এই প্রদর্শনী। প্রত্যেকটি আলেঅকচিত্রের পেছনে রয়েছে একেকটি গল্প। সেখানে রাখা একটি ছবিতে দেখা যায় নানা রঙের মাটির চিত্র। এই মাটিগুলোর রঙ ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণ নানা মাত্রায় সেই মাটিগুলোতে সিসা রয়েছে। কোথাও সিসার প্রভাবে পুড়ে যাওয়া গাছের পাতা। কোনো ছবির পেছনে কবুতর মরে যাওয়ার গল্প। কোনো ছবিতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে না ওঠা শিশুরা।

সিসা বিভিন্নভাবে ছড়াচ্ছে। ব্যাটারি ভাঙা শিল্প, সিসাযুক্ত দেয়ালের রঙ, অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিল, খাবার রাখার সিরামিকের পাত্র, ই-বর্জ্য, খেলনা, সার, রান্নায় ব্যবহৃত বিভিন্ন মসলা, প্রসাধনী, চাষ করা মাছের জন্য তৈরি খাবারের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে এই ক্ষতিকর পদার্থটি।

খাবারের মাধ্যমে, শরীরের চামড়ার মাধ্যমে ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে এটি। সিসায় দূষিত মাটির সবজি, মসলা (হলুদ চকচকে করতে মেশানো হয়), সিসাযুক্ত সিরামিকের বাসনপত্রের রান্না করা খাবার, বাজারজাত করা দুধ খাওয়ার মাধ্যমে সিসা মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। এছাড়া সিসায় দূষিত মাটিতে খেলাধুলা করলে বা এই মাটির সংস্পর্শে এসে কোনো ধরনের কাজ করলে চামড়ায় সিসাযুক্ত ধুলির আস্তরণ পড়ে। আস্তে আস্তে সেটি শরীরে প্রবেশ করে।

খাবারে ব্যবহৃত হলুদে পাওয়া গেছে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি। “পিওর আর্থ”-এর ফটো এক্সিবিশন থেকে ছবি তুলেছেন অর্বাক আদিত্য/ঢাকা ট্রিবিউন

শিশুর খেলনায় সিসার উপস্থিতি পেয়েছে “পিওর আর্থ”। পানির পাইপে, সিরামিক ও অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্রসহ ২০০টি নিত্য-ব্যবহার্য জিনিসপত্রে সিসার দেখা মিলেছে সংস্থাটির পরীক্ষায়। মাটি পরীক্ষা করা, বাসনপত্র পরীক্ষা করা, শিশুর রক্ত পরীক্ষা করার আলোকচিত্রও রয়েছে প্রদর্শনীতে।

প্রদর্শনীতে কথা হয় “পিওর আর্থের” জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থাপক বুশরা হুমায়রা সাদাফের সঙ্গে। তিনি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা ভয়াবহ এই সিসা দূষণ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করছি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা গড়ে উঠছে। এসব এলাকায় সিসা দূষণ দ্রুত ছড়াচ্ছে। সেখানে গিয়ে সেখানকার মাটি পরীক্ষা করছি, এর প্রভাব নিয়ে মানুষকে সচেতন করছি।”

সিসা দূষণ রোধে কাজ করার কথা জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের বর্জ্য ও রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক রাজিনারা বেগম বলেন, “সিসা দূষণের উৎস ও প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। জাতীয় পর্যায় থেকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। সিসাদূষণ রোধে সহযোগী হয়ে কাজ করবে পরিবেশ অধিদপ্তর।”

এই দূষণ রোধে মাল্টি-সেক্টরাল উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আনোয়ার সাদাত। তিনি বলেন, “সিসা দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। পিওর আর্থের প্রদর্শনীতেও সেই ভয়াবহতা উঠে এসেছে। এখন এটি রোধ করতে হলে মাল্টি-সেক্টরাল উদ্যোগ নিতে হবে।”

“পিওর আর্থ” বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. মাহফুজার রহমান বলেন, “সিসাদূষণের ফলে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে এর কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এখানে সিসা দূষণের উৎস বিস্তৃত ও উদ্বেগজনক। দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিকের রান্নার ও খাওয়ার বাসনপত্র, দেয়ালের রং, খেলনা, চালে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।”

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও ঝুঁকি কমাতে কঠোর নীতিমালা ও এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।

   

About

Popular Links

x