Thursday, May 22, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

বিদেশি ফলের বিকল্প কিছু দেশি ফল

কমলা, আপেল, আঙ্গুর ও মাল্টার দাম এখন সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। তাই সেহরি ও ইফতারে ফলের চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায় দেশি ফল

আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৪, ০২:০৮ পিএম

প্রতি বছরের মতো এই রমজানেও আগেভাগেই বাড়ছে বিদেশি ফলের দাম। ইফতারের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের পাশাপাশি কমলা, আপেল, আঙ্গুর ও মাল্টার দাম এখন সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ডলার-সংকট ও বাড়তি দরে শুল্কায়ণের কারণে গত বছরের দামকেও ছাড়িয়ে গেছে এবারের ফলের বাজার। তাই সেহরি ও ইফতারে ফলের চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায় দেশি ফল। এই পরিপ্রেক্ষিতে চলুন জেনে নেই, কোন কোন দেশি ফলগুলো এবারের ইফতার ও সেহরিতে বিদেশি ফলের সেরা বিকল্প হতে পারে।

বেল

কাঁচা ও পাকা দুই অবস্থাতেই সমান জনপ্রিয় ফল বেল। এতে থাকা টনিক এবং ফেনোলিক উপাদান দুটি মূলত উচ্চমাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি আলসার, ডায়রিয়া, আমাশয় এবং অন্যান্য হজম সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর চিকিৎসায় অনেক উপকারী। রোজার সময় নতুন খাদ্যাভ্যাসের কারণে অনেকেই প্রথম দিকে নানা ধরণের হজমজনিত জটিলতায় ভুগেন। এমতাবস্থায় বেল হতে পারে সেরা প্রতিষেধক।

বেলে থাকা রাইবোফ্ল্যাভিন এবং থায়ামিন পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। বেলের রস কিডনির রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং অন্ত্রকে সুস্থ রাখে। ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় এর মধ্যে রয়েছে রেচক বৈশিষ্ট্য। ফলে এটি প্রাকৃতিক ভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বদহজম নিয়ন্ত্রণে অংশ নিতে পারে।

বেলের শরবতের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে খেলে শরীরের দুর্বলতা এবং ক্লান্তি ভাব দূর হয়। ১১ মাস পর হঠাৎ দিনের একটা বিরাট সময় উপোষ থাকার ক্ষেত্রে ক্লান্তি ভাব আসাটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বেলের এই আইটেমটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পেঁপে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে বেশ উপকারী/পিক্সাবে

পেঁপে

তরকারি, শুকনো ফল, সালাদ সব ভাবেই প্রতিদিনের আহারে রাখার মতো একটি ফল হচ্ছে পেঁপে। এতে থাকা প্যাপেইন নামক অ্যানজাইমটি হজমে অবদান রাখে। পেঁপেতে যথেষ্ট পরিমাণে পানি ও ফাইবার রয়েছে, যা যুগ্মভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে ও পরিপাকতন্ত্রকে উন্নত করতে সহায়তা করে।

এছাড়াও এতে আছে ভিটামিন ও পটাশিয়াম। ইফতারের মুখরোচক খাবার যারা একদমই এড়িয়ে যেতে পারেন না, তাদের খাদ্য তালিকায় পেঁপে যোগ করা উচিত। অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া কোলেস্টেরল ও সোডিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সেখানে পেঁপের মতো পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।

এই ফলের সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ রাসায়নিক উপাদানটি হচ্ছে কোলিন। একটি স্বাস্থ্যকর ঘুম, পেশীর যথাযথ নড়াচড়া এবং স্মৃতিশক্তির বিকাশে একটি বহুমুখী পুষ্টি উপাদান এই কোলিন। এর কার্যকারিতার মধ্যে রয়েছে কোষ ঝিল্লির গঠন বজায় রাখা, মস্তিষ্কের নিউরনের উন্নয়ন সাধন, চর্বি শোষণ এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ কমানো।

আনারস

ইফতারের আয়োজনে দারুণ এক সংযোজন হতে পারে আনারস। এতে থাকা ভিটামিন সি ও ম্যাঙ্গানিজ হজমে সাহায্য করে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোযা অবস্থায় শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এড়াতে সহায়তা করে।

অক্সিডেটিভ স্ট্রেস মূলত প্রচুর পরিমাণে ফ্রি র‍্যাডিকেলের কারণে ঘটে, যা নানা ধরণের শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার হ্রাস, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং কিছু কিছু ক্যান্সারের দিকেও ধাবিত করে।

আনারসে ব্রোমেলাইন নামক পাচক এনজাইমের একটি গ্রুপ রয়েছে, যা মাংসের হজম সহজ করতে পারে। ব্রোমেলাইন প্রোটিন অণুগুলোকে ভেঙে দেয়, ফলে ক্ষুদ্রান্ত্রের শোষণ কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই সেহরিতে গরু বা মুরগির মাংস দিয়ে ভারী খাবারের পর আনারস খাওয়া যেতে পারে।

এই ফলে আরও আছে প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য, যা সামগ্রিক ভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।

কলা/প্রতীকী ছবি/পেক্সেলস

কলা

বারমাসি জনপ্রিয় ফল কলা ইফতার ও সেহরি দুই সময়ের জন্যই ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। ফাইবার ও প্রতিরোধী স্টার্চের উৎস হওয়ায় কলা সারাদিন উপবাস অভ্যাসের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। প্রতিরোধী স্টার্চ দেহে স্বল্প পরিমাণে পূর্ণতার এক অনুভূতি সৃষ্টি করে।

শুধু তাই নয়, এতে বিদ্যমান পটাসিয়াম তৃষ্ণা নিবারণ করে এবং রোজাদারকে দীর্ঘ সময়ের জন্য হাইড্রেটেড রাখে। এক কথায়, তিন বেলা আহারের বিপরীতে ৮ ঘণ্টা দূরত্বে দুই বেলা খাবারের ধাক্কা সামলানোর জন্য কলা একটি সেরা ফল।

পেয়ারা

কমলার চেয়ে চারগুণ বেশি ভিটামিন সি, আনারসের চেয়ে তিনগুণ বেশি প্রোটিন ও চারগুণ বেশি ফাইবার এবং কলার চেয়ে বেশি পটাসিয়াম। আর এই পরিসংখ্যানই পেয়ারাকে সব ফলের উপরে আধিপত্য দিয়েছে।

ভিটামিন সি-এর কাজ সামঞ্জস্যপূর্ণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখা। এর সঙ্গে অতিরিক্ত শক্তি হিসেবে যোগ হয় পেয়ারায় থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তবে এই ফলের প্রধান পুষ্টি উপাদান হচ্ছে ফাইবার, যা মলকে নরম করে পেট পরিষ্কার ও হজমে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি ডায়রিয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রাথমিক লক্ষণেই শরীরে পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা গঠন করতে পারে।

বরই

অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করতে আরও একটি প্রয়োজনীয় ফল বরই। এর প্রধান পুষ্টি উপাদান ফেনোলিক যৌগ এবং ভিটামিন সি সম্মিলিতভাবে ক্ষতিকারক ফ্রি র‍্যাডিকেল ধ্বংসে অংশ নেয়। ফলশ্রুতিতে, কোষের ক্ষতি হ্রাস সহ হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমে আসে। একই সঙ্গে ভিটামিন সি শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন ও কার্যকারিতা বাড়ায়। ফলে শরীর প্রস্তুত থাকে যেকোনো ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য।

এছাড়াও বরইয়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদাহ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। এতে করে কোলেস্টেরলের অক্সিডেশন রোধ হয়, ফলে রক্ত ধমনীতে প্লেক তৈরির আশঙ্কা দূর হয়। উপরন্তু, এই ফলে উচ্চ মাত্রার ফাইবার অন্ত্রে কোলেস্টেরল শোষণ কমায়, যা রক্তের উন্নত লিপিড প্রোফাইলের নিশ্চায়ক।

বরইয়ের কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ ক্ষমতাও রয়েছে। এর ফাইবার উপাদান অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার জন্য পুষ্টি প্রদান করে। এই প্রক্রিয়া পুষ্টি শোষণ, নরম মলত্যাগ ও সঠিক হজমের মাধ্যমে সামগ্রিক অন্ত্রের স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সেহরি ও ইফতারের মাঝের সময়গুলোতে খাদ্যতালিকা থেকে অস্বাস্থ্যকর খাবার সরিয়ে বরই যোগ করাটা উত্তম। কেননা এটি উপবাস ছাড়া সময়ে দেহে প্রবেশকৃত খাবারগুলোর সঠিক প্রক্রিয়াকরণ করতে সাহায্য করবে।

রমজানের এক সপ্তাহ আগেই বেড়েছে ফলের দাম/ফাইল ছবি/ঢাকা ট্রিবিউন

তরমুজ

রমজান মাসে অন্যান্য খাদ্যের সঙ্গে পানি থেকেও বিরত থাকতে হয়। তাই সঠিক বিপাকের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় দেহের পানির ভারসাম্য ঠিক রাখা। এই প্রয়োজনীয়তার পুরোটাই পূরণ করতে পারে তরমুজ।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পাশাপাশি এই ফলে রয়েছে লাইকোপিন এবং ভিটামিন সি-এর সংমিশ্রণ। তাই আনারস ও বরইয়ের মতো প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে তরমুজও অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

তরমুজে বিদ্যমান সিট্রুলাইন নামক অ্যামিনো অ্যাসিড ব্যায়ামের সময় কর্মক্ষমতা উন্নত করা এবং পেশীর ব্যথা কমাতে কাজ করে। তাই খাদ্য তালিকায় তরমুজ থাকলে রোযা রেখে শরীর চর্চা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

তরমুজের মোট ওজনের থেকেও বেশি পরিমাণে পানি আর সঙ্গে অল্প ফাইবার স্বাস্থ্যকর হজমের জন্য উপযোগী। এই পুষ্টি মিশ্রণটি পাচনতন্ত্রের মাধ্যমে বর্জ্য নিষ্কাশন করে অন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখে।

আমলকী

বিপাক জনিত যাবতীয় সমস্যা নিরসনে আরও একটি ফাইবার সমৃদ্ধ ফল আমলকী। তবে এর শ্রেষ্ঠ ক্ষমতা হচ্ছে এর উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি, যা শরীরকে অন্যান্য পুষ্টি গ্রহণে সব সময় প্রস্তুত রাখে। ১০০ গ্রাম আমলকী থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এটি একজন প্রাপ্তবয়স্কের দৈনিক প্রয়োজনীয় চাহিদার দ্বিগুণেরও বেশি। ভিটামিন সি-এর উচ্চ ঘনত্ব শরীরে নোরপাইনফ্রিন তৈরি করে। এটি মূলত একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে।

আমলকীর ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো ফ্রি র‍্যাডিকেলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো সুরক্ষিত থাকে এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত হয়। তাই রমজান মাসে শরীরকে যে কোনও রোগের বিরুদ্ধে একটি দুর্গ বানানোর জন্য সেরা ফল আমলকী।

ডাব বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা/ফাইল ছবি/ঢাকা ট্রিবিউন

ডাব/নারিকেল

সারাদিন রোজায় শরীরের হারানো পুষ্টি পুনরুদ্ধারের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ডাবের পানি খাওয়া। শরীরে প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণের পুরোটাই দিতে পারে এই উপকূলীয় ফলটি। পটাসিয়ামে ভরপুর এই ফল একই সঙ্গে ভারী খাবারেরও পরিপূরক। কেননা এতে আছে উচ্চ ক্যালোরি এবং চিনি। তাই শুধু তৃষ্ণা মেটাতেই নয়, অধিক সময় ধরে দেহে পূর্ণতা বজায় রাখার জন্য ডাবের পানি বা শ্বাস উৎকৃষ্ট খাদ্য।

বাঙ্গি

যেহেতু গ্রীষ্ম ও রমজান একসঙ্গেই আসছে, তাই পানিশূন্যতা থেকে শরীরকে বাঁচানোর জন্য খাবারের তালিকায় রাখা যেতে পারে বাঙ্গি। এটি রোদের দাবদাহ থেকে শুধু রক্ষাই করে না, সারা শরীরে শীতল অনুভূতিরও সঞ্চার করে।

ভিটামিন সিসহ এতে থাকা অন্যান্য ভিটামিনগুলো শরীরের শ্বেত রক্তকণিকাকে উদ্দীপিত করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ভিটামিন এ এবং ফাইটোকেমিক্যাল অন্ত্রকে সুস্থ রাখে। এছাড়া এর ফাইবার পানির অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেটকে ঠাণ্ডা রাখে।

প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম সমৃদ্ধ বাঙ্গি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে। এই পটাসিয়ামে স্ট্রেস উপশমকারী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এর উপস্থিতি মনোনিবেশ এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধের মানসিক বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে।

পরিশিষ্ট

সেহরি ও ইফতারের জন্য এই দেশি ফলগুলো দামের দিক থেকে বিদেশি ফলের তুলনায় তুলনামূলক ভাবে বেশ সাশ্রয়ী। তাছাড়া আনারস, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, বরই, ও ডাবের যথেষ্ট সরবরাহ থাকায় তা সর্বশ্রেণীর ক্রেতাদের জন্য সহায়ক হবে। ইতোমধ্যে তরমুজও বাজারে চলে আসায় গরম থেকে মুক্তির সম্ভাবনাও মিলছে।

তৃষ্ণা নিবারণ থেকে শুরু করে হাল্কা নাস্তা; এমনকি ভারী খাবারের চাহিদা পূরণেও এই ফলগুলো যথেষ্ট। অর্থাৎ শুধু মূল্যের দিক থেকেই নয়, এই ফলগুলো দিয়ে অনায়াসেই রোযার মাসটিকে স্বাস্থ্যকর করে তোলা সম্ভব।

   

About

Popular Links

x