ঝুঁকি নেওয়া এবং অসম্ভবকে সম্ভব করার অভিপ্রায় মানুষের মজ্জাগত। অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মানুষ অসংখ্য অসাধ্য সাধন করেছে। পা রেখেছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায়।
একটা সময় এভারেস্ট জয় করা মানুষের জন্য কেবলই স্বপ্ন ছিল। তবে ১৯৫৩ সালে সেই স্বপ্ন সত্যি করেন নিউজিল্যান্ডের পর্বাতারোহী এডমন্ড হিলারি এবং দার্জিলিংয়ের শেরপা তেনজিং নোরগে। ওই বছরের ২৯ মে তারা পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছান।
তবে বাংলাদেশি পর্বাতারোহীদের এভারেস্ট যাত্রা শুরু হয় আরও অনেক পরে। মূলত একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে শুরু হয় বাংলাদেশিদের এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রা।
২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশি ছয়বার এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন। তবে এরপর দীর্ঘ বিরতি। গত ১১ বছরে তৃতীয় মেরুতে আর ওড়েনি লাল-সবুজের পতাকা।
অবশেষে ২০২৪ সালে এসে সেই অচলায়তন ভাঙ্ল। ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের চূড়া জয় করলেন বাবর আলী।
রবিবার (১৯ মে) স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায় (বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট) এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।
বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান।
এরপর থেকেই এভারেস্ট জয় করা ষষ্ঠ বাংলাদেশি বাবর আলী সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ বেড়ে গেছে।
বিভিন্ন দুঃসাহসিক কাজের জন্য পরিচিত হলেও বাবর পেশায় একজন চিকিৎসক। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগামে। জেলার হাটহাজারীর বুড়িশ্চর এলাকার লিয়াকত আলী ও লুৎফুন্নাহার বেগম দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান বাবর আলী।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে বাবর মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) সম্পন্ন করেন।
চিকিৎসা পেশায় কাজও শুরু করেছিলেন বাবর আলী। তবে রক্তে যে তার দেশ-বিদেশে ঘোরার নেশা। এক অভিযানের সময় কর্মস্থল থেকে ছুটি না মেলায় ছেড়ে দেন চাকরি। এরপর থেকে তার পুরোটা মনোযোগ ভ্রমণে।
পেশাগত জীবনে আইসিডিডিআরবি’র উদীয়মান সংক্রামক রোগ বিভাগে এবং জাতিসংঘের আন্তজার্তিক অভিবাসন সংস্থায় মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
বাবরের এভারেস্ট জয়
এভারেস্ট জয়ের লক্ষে এ বছরের ১ এপ্রিল নেপালের উদ্দেশে যাত্রা করেন বাবর আলী। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে তিন দিন পর তিনি কাঠমান্ডু থেকে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর লুকলায় যাত্রা করেন।
শত শত কিংবদন্তি পর্বতারোহীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১০ এপ্রিল এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছান বাবর। এরপর ১৪ এপ্রিল মধ্যরাতে বেস ক্যাম্প থেকে শুরু হয় তার স্বপ্নযাত্রা।
প্রথম দিন তিনি পৌঁছে যান ২১ হাজার ৩০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ক্যাম্প-২ এ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ মে বাবর ২৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় ক্যাম্প-৩ এ পৌঁছান এবং সেখান থেকে ১৯ মে ক্যাম্প-৪ এ পৌঁছান। ২৬,০০০ ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের উপরের অংশকে বলা হয় “ডেথ জোন”।
সব বাধা পেরিয়ে মৃত্যুভীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ১৯ মে সকালের সূর্য কিরণে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় ১১ বছর পর তিনি মেলে ধরেন লাল সবুজের পতাকা।
বাবরের অন্যান্য অর্জন
চিকিৎসক ও সমাজকর্মী বাবর আলীর এভারেস্ট জয়ের আগেও বেশকিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে।
২০২৩ সালে বাবর আলী প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ভারতের দীর্ঘতম হাইওয়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত চার হাজার কিলোমিটার সাইক্লিং করেন।
এর আগে তিনি ২০২২ সালে ভোমরা-তামাবিল, ২০২১ সালে হালুয়াঘাট-কুয়াকাটা, ২০১৭ সালে টেকনাফ-তেঁতুলিয়া এবং আখাউড়া-মুজিবনগর সাইক্লিং করেন।
২০১৯ সালে প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে পায়ে হেঁটে দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেন।
এছাড়াও তিনি অসংখ্য ম্যারাথন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছেন। ২০২১ সালে তিনি আন্তর্জাতিক ডাইভিং সংগঠন ডাইভিং ইন্সট্রাকশন অ্যাসোসিয়েশনের (ডিআইডব্লিউএ) স্কুবা ডাইভিং কোর্স সম্পন্ন করেন।
বাবর আলী ২০১৯ সালে কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই এবং ২০১৭ কাপ্তাই-বিলাইছড়ি- কাপ্তাই কায়াকিং করেন।
তিনি "পায়ে পায়ে ৬৪ জেল" এবং "সাইকেল-এর সাওয়ারি" নামে দুটি বই লিখেছেন। অনুবাদ করেছেন "ম্যালরি ও এভারেস্ট" নামের একটি বই।
এছাড়াও তিনি নিয়মিত দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য ম্যাগাজিন ও লিটল ম্যাগে তার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লেখেন।
বাবরের লক্ষ্য লোৎসে
এভারেস্ট জয়ের পর বাবরের লক্ষ্য বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট লোৎসে জয় করা। আর এটি হলে তিনিই হবেন লোৎসে জয় করা প্রথম বাংলাদেশি। এছাড়া এর আগে কোনো বাংলাদেশি একই অভিযানে দুটি আট হাজার মিটারের পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেননি।