তিনি চান উপকূলের শিশুরা যেন ঝরে না পড়ে, তাদের ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর হয়। সবার জন্য বাসযোগ্য ও নিরাপদ উপকূল এই তরুণের স্বপ্ন
চলতি বছরের ১৯ মে সুপার সাইক্লোন আম্ফান যখন প্রচণ্ড দাপটে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছিল তখন উপকূলবাসীকে নিরাপদে আশ্রয়স্থলে যাওয়ার জন্য বার বার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব এড়াতে আবহাওয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে মানুষকে সতর্ক করা হচ্ছিল।
সেদিন আম্ফানের গতিবিধি ও উপকূলে তার প্রভাব জানতে টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে কান পেতে ছিলেন দেশবাসী।
কিন্তু উপকূলের যেসব মানুষের হাতে স্মার্টফোন কিংবা বাড়িতে টেলিভিশন নেই তাদের কাছে ঝড়ের আগাম খবর পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করছিলেন ছিপছিপে গড়নের এক তরুণ। উপকূলের ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে সতর্ক করতে শাহিন আলম নামে ওই তরুণের চেষ্টা ছিল আপ্রাণ।
শুধু তাই নয়। কখনও গলা পানিতে নেমে, কখনওবা অশান্ত কপোতাক্ষ অথবা খোলপেটুয়া নদীর উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে সাতক্ষীরা ও খুলনার কয়রা উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে জরুরি ত্রাণ সামগ্রীও পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেছেন ২০ বছর বয়সী এই তরুণ।
আম্ফান পরবর্তী সময়ে কয়রার দুর্গম এলাকা কাটমারচরের সর্বত্র পানিতে থৈ থৈ করছিল। সেখানকারই একটি কাঁচা বাড়ি কোনোমতে পানিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড ঘরটি দূর থেকে দেখে মনে খালিই মনে হচ্ছিল শাহিনের। তবুও কৌতুহল মেটাতে দলবল নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখা গেলো, ঘরের মধ্যে ছয়-সাতজনের একটি পরিবার। রয়েছেন এক গর্ভবতী নারীও। কাছাকাছি কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় এবং ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে তলিয়ে যাওয়ায় স্বজনরা তাকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেননি।
শাহিন আলমের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপকুর ইউনিয়নের পাতাখালী গ্রামে। তার বাবা এসএম শহিদুল্লাহ ও মা জাহানারা খানম। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি।
উপকূলীয় এলাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠার কারণে খুব কাছ থেকে শাহিন দেখেছেন সেখানকার মানুষের জীবন সংগ্রাম। উপকূলের বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে পানির নিবিড় বন্ধুত্ব। এই পানি আর সুন্দরবনই তাদের আয়ের প্রধানতম উৎস। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, চারদিকে পানিবেষ্টিত এই এলাকায় নিরাপদ খাওয়ার পানির সঙ্কট তীব্র।
চিংড়ি, কাঁকড়া, কুচেসহ অনেকগুলো সম্ভাবনাময় শিল্পের এলাকায় নেই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আবার আর্থিক অনটনে শিশুদের ঝরে পড়া, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা, পুষ্টিকর খাবারের অভাব এসব কিছুই খুব কাছ থেকে দেখে বেড়ে ওঠা শাহিনের।
তাই নিজের এলাকা অবহেলিত উপকূলের জন্য কিছু একটা করার প্রচেষ্টা তার শৈশব থেকেই।
তাই গল্পের শুরুটাও দুরন্ত শৈশবেই। ২০০৯ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় আইলা উপকূলকে বিধ্বস্ত করে দেয় তখন শাহিনের বয়স মাত্র ৮।
তার ভাষায়, “ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় থেকেই বুঝতে শুরু করেছি উপকূলের মানুষের জীবন সংগ্রাম। আইলা চলে যাওয়ারও দীর্ঘদিন পর আমরা ঘরের মধ্যে মাচা করে থাকতাম। জোয়ারের সময় ঘরে পানি ঢুকতো। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ঘরে কোনো খাবার ছিলো না। দ্বীপে ট্রলার এলেই এই ভেবে ছুটে যেতাম যে, এই বুঝি কেউ আমাদের জন্য কিছু নিয়ে এলো!”
“তখন ছোটদের জন্য বিশেষ কিছু আসতো না ত্রাণের ট্রলারে। খুব কষ্ট লাগতো। সেসময় থেকেই ভাবতাম উপকূলের অবহেলিত শিশুদের জন্য, আমাদের জন্য কিছু করার।”
এরপর প্রতিবেশী ও আশপাশের দু-একটি পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষের জন্য ধীরে ধীরে কাজ শুরু করেন শাহিন।
সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৯-এর নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর উপকূলের মানুষের জন্য খাবার এবং নিরাপদ পানি নিয়ে গেছেন। সেইসঙ্গে শিশুদের কথা জন্য পুষ্টিকর খাবার ও খেলনা এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। স্যানিটারি ন্যাপকিন দিয়েছেন উপকূলের কিশোরীদের হাতে।
চলমান করোনাভাইরাস মহামারিতে মানুষকে সচেতন করতে বারবার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য কাজ করেছেন। সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করেছেন উপকূলের মানুষের মাঝে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রলয় শাহিনের ব্যস্ততা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। চলতি বছরের মে থেকে এখনও তাই তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
এই তরুণের পা দুটো যেমন পৌঁছে যায় উপকূলের বাড়ি বাড়িতে, ঠিক তেমনই সেখানকার বাস্তব চিত্র তুলে আনে তার ক্যামেরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় উপস্থিতির মাধ্যমে সাতক্ষীরার এই তরুণ সবসময় উপকূলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরেন। যেসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সচরাচর গণমাধ্যমকর্মীরা যেতে পারেন না সেসব জায়গাতে গিয়েও নিয়মিত ফেসবুকের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কথা।
তার তোলা ছবি আর লাইভ ভিডিও দেখেই দেশ-বিদেশের অনেক বিত্তবান মানুষ ও সংগঠন উপকূলবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে।
এসব কাজে আত্মতৃপ্তির কথা জানিয়ে শাহিন বলেন, যখন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই, অবহেলিত শিশুদের জন্য কিছু করতে পারি তখন যে ভালোলাগা কাজ করে সেটা তুলনাহীন। এসব শিশুর মুখে হাসি দেখলে নিজেকে সফল মনে হয়।
পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই তিনি জড়িত আছেন সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে। তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডি নিউজ ২৪.কমের হ্যালো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। বর্তমানে সাতক্ষীরার স্থানীয় গণমাধ্যমে কাজ করছেন। নিয়মিত তুলে ধরছেন উপকূলবাসীর দুঃখ-দুর্দশার কথা।
শাহিনের চাওয়াও খুব বেশি নয়। তিনি চান উপকূলের শিশুরা যেন ঝরে না পড়ে, তাদের ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর হয়। সবার জন্য বাসযোগ্য ও নিরাপদ উপকূল এই তরুণের স্বপ্ন।
মতামত দিন