অবরুদ্ধ গাজায় তিন মাসের অবিরাম বোমা বর্ষণে অন্তত ৭০% ঘরবাড়ি একেবারে ধ্বংস হয়েছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক বোমাবর্ষণে ২০০টিরও বেশি ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ধ্বংস হয়েছে।
গাজার ৪,৩৯,০০টি বাড়ির মধ্যে প্রায় ৩,০০,০০০টি বাড়িই ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে এতে বলা হয়, আবাসিক এলাকা, বাইজেন্টাইন গির্জা, হাসপাতাল এবং শপিং মল ও বেসামরিক অবকাঠামোতে অন্তত ২৯,০০০ বোমা ফেলা হয়েছে। এসব ঘরবাড়ি এতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে সেগুলো আর মেরামতের যোগ্য নেই।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট পেপ বলেন, “সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণের শিকার অন্যান্য শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে গাজা।”
“২০১২ থেকে ২০১৬ সালে সিরিয়ার আলেপ্পো, ইউক্রেনের মারিউপোল, বা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির মিত্রবাহিনীর বোমা হামলার চেয়েও বেশি ধ্বংসযজ্ঞ গাজায় গত দুই মাসে হয়েছে।”
“আইএসআইএল (আইএসআইএস) গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিন বছরের অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের চেয়ে বেশি বেসামরিক লোককে হত্যাও হয়েছে ওই অঞ্চলে।”
রবার্ট পেপ বলেন, “১৯৪২-১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনী জার্মানির প্রধান শহরসহ ৫১টি শহরে হামলা করে ৪০-৫০% শহুরে এলাকা একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল।”
তিনি বলেন, “বেসামরিক নাগরিক নিপীড়নে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ উদাহরণের মধ্যে একটি গাজায় হামলার ঘটনা। এখানে ইতিহাসের চতুর্থ সর্বোচ্চ বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে।”
সিইউএনওয়াই গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের কোরি শের এবং ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যামন ভ্যান ডেন হোয়েক বলেন, “মহাকাশ থেকে দেখতে গাজা এক ধ্বংসের অঞ্চলে রুপ নিয়েছে।”
গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ২১,৫০০ জনেরও বেশি নিহত ও ৫৫,০০০ আহত হয়েছে।
৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় আহত এক হাজারেরও বেশি শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালানোয় তারা হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তু করছে। হামাসের ওই হামলায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। এরপরই সেখানে বিরোধের সূত্রপাত ঘটে।
হামাস বলছে, গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ অব্যাহত রাখা ও অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে বসতি সম্প্রসারণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে হামলা চালানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বলে বিবেচিত ইসরায়েলি বসতিকে ফিলিস্তিনিরা ভবিষ্যত রাষ্ট্র গঠনে বড় বাধা হিসেবে মনে করেন।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রধান এফ্রেইম ইনবার বলেন, “হামাস বেসামরিক জনসংখ্যার মধ্যে নিজেদের গভীর অবস্থান তৈরি করেছে। এই কারণেই ধ্বংসের মাত্রা বেড়েছে।”
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যে একটি গাজা। ৩৬৫ ৩৬৫ বর্গ কিলো মিটার (১৪১ বর্গ মাইল) ভূমিতে ২.৩ মিলিয়ন মানুষ বাস করে।
গাজায় বোমা হামলার জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। এরমধ্যে ৭০% এরও বেশি শিশু, নারী ও বয়স্ক।
অবরুদ্ধ অঞ্চলের জনসংখ্যার ৯০% এরও বেশি এখন বাস্তুচ্যুত। তারা তিন বেলা খাবার যেমন পাচ্ছেন না, তেমনই আশ্রয়ডশিবিরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে নানা রোগ। ইসরায়েলের তীব্র অবরোধে ওই অঞ্চলে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছানো দুরূহ হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় কী ধরনের বোমা ও কামান ব্যবহার করছে তা নিয়েও খুব একটা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনাস্থলে পাওয়া বিস্ফোরণের টুকরা ও হামলার ভিডিও বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “হামলায় ব্যবহৃত বোমার বেশিরভাগই মার্কিন-নির্মিত।”
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় শত শত মানুষকে হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে ২,০০০ -পাউন্ড (৯০০ কেজি) বাঙ্কার-বাস্টার বোমা।
ইউএস নিউজ নেটওয়ার্ক সিএনএন গত ১৪ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধাস্ত্রের প্রায় অর্ধেকই ছিল “নকল” (অতিরিক্ত বিপজ্জনক)।
এ সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলি এক কর্মকর্তাও স্বীকার করে বলেন, “বড়দিনের আগে গাজায় একটি শরণার্থী শিবিরে হামলায় অতিরিক্ত মৃত্যুর কারণ ছিল সেখানে অনুপযুক্ত যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাস ব্যবহারের অভিযোগ করেছে। যদিও ইসরায়েল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, প্রতিটি হামলা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলছে কি না তা নিশ্চিত করতে আইনি উপদেষ্টাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, “আমরা প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুর জন্য সঠিক যুদ্ধাস্ত্র বেছে নেই। যাতে এটি অপ্রয়োজনীয় ক্ষতির কারণ না হয়।”