ভাইরাসজনিত মহামারি ছড়ানো নির্ভর করে ভাইরাসের রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বারের ওপর। রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার যদি শূন্য হয় তবে ভাইরাসটি একজন থেকে অপরজনের কাছে ছড়ায় না। রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার ১ হলে একজন থেকে অপরজনের কাছে ছড়ায়, এই সংখ্যা ২ হলে জিওমেট্রিক হারে ছড়াতে থাকে
পৃথিবীর ইতিহাসে ছোট-বড় নানা মহামারিতে মানবজাতি আক্রান্ত হয়েছে অসংখ্যবার। বড় মহামারি যেমন- জাস্টিনিয়ান প্লেগ, দ্য ব্ল্যাক ডেথ, দ্য গ্রেট প্লেগ, কলেরা, ইয়োলো ফিভার, স্প্যানিশ ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, ইবোলা ইত্যাদি পৃথিবী থেকে কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি প্রাণ।
প্রাচীন গ্রিসে টাইফাস মহামারিতে এথেন্সের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়। বিউবনিক প্লেগে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়, যা তৎকালীন জনসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ’’ খ্যাত প্লেগ মহামারিতে পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। অন্যান্য মহামারিতে মৃত্যুর পরিসংখান উল্লেখ করলে প্রবন্ধের পরিধি কেবল বাড়তেই থাকবে। তবে বাস্তবতা হলো, সেই পৌরাণিক সময় থেকে অদ্যাবধি নানা মহামারি পৃথিবী থেকে কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য প্রাণ।
আমরা যদি বিভিন্ন মহামারির এপিডেমিক গ্রাফকে ভিজুয়ালাইজ করি তাহলে একটি অদ্ভুত মিল দেখতে পাব। প্রায় প্রতিটি মহামারিতেই কার্ভের শুরুর দিক থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটা এক্সপোনেনশিয়াল অথবা জিওমেট্রিক শেপের মত হয়ে থাকে। কার্ভের পিক হঠাৎ বেড়ে যেতে থাকে। মহামারি শেষ হওয়ার পর কার্ভটি যে আকৃতি পায় তা অনেকটা নরমাল ডিস্ট্রিবিউশনের কাছাকাছি হয়ে থাকে, তবে পুরোপুরি নরমাল নয়।
ছবি- ইবোলা, গ্রেট প্লেগ, সার্স, স্পানিশ ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, ইয়োলো ফিভার মহামারির এপিডেমিক গ্রাফ
বর্তমানে মানবসভ্যতার সামনে এক ভয়াবহ বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্য কোনো মহামারী এত দ্রুত এমন ভয়াবহ রূপে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েনি। লেখাটি যখন লিখছি ঠিক এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ লাখ ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে। কোভিড-১৯ এর এপিডেমিক গ্রাফের দিকে তাকালে আমরা সেই একই কার্ভের সম্মুখভাগ দেখতে পাই। করোনাভাইরাস শুরুর দিক থেকে এক্সপোনেনশিয়াল রূপে এগোচ্ছে, ভাইরাসের আক্রান্তের হার ক্রমশ কার্ভটিকে হাই পিকে নিয়ে যাচ্ছে। কার্ভের কার্টোসিস ক্রমশ সূচালো হচ্ছে।
ছবি - করোনার এপিডেমিক কার্ভ এবং চীনের এপিডেমিক কার্ভ
প্রশ্ন হচ্ছে কার্ভের পরিণতি কী হতে পারে? কোনো এপিডেমিক কার্ভের ট্রেন্ড আজীবন এক্সপোনেনশিয়াল থাকা সম্ভব নয়, অনন্তকাল ধরে যদি আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণের সংখ্যা বাড়তেই থাকে তবে মানবজাতির অস্তিত্ব সেখানেই বিলুপ্ত হবে। এজন্যই স্রষ্টা কোনো মহামারীর কার্ভকে এক্সপোনেনশিয়াল রাখেননি, অন্তত অতীতের গ্রাফগুলো তাই বলে (ছবি-১)। কার্ভের আরেকটি পরিণতি হতে পারে লজিস্টিক কার্ভের মতো অর্থাৎ হাই পিকের পরে প্যারালাল হয়ে যাবে, বাস্তবে সেটাও সম্ভব নয় কারণ আক্রান্তের সংখ্যা কখনোই স্থির থাকবে না, প্রতিনিয়ত কেউ সুস্থ হয়ে যাবে, কেউ মৃত্যুবরণ করবে অথবা কেউ নতুন আক্রান্ত হবে। সুতরাং কার্ভের আরেকটি পরিণতি থাকে সেটা হল নিম্নমুখী হওয়া। বাস্তবে অতীতের প্রতিটি মহামারীতে সেটিই হয়েছিল, কার্ভের পিক হাই হওয়ার পর সময়ের সাথে সাথে ক্রমশঃ নিম্নমুখী হতে হতে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।
করোনার কার্ভের দিকে লক্ষ্য করলে এক্সপোনেনশিয়াল অংশটি অতীতের প্রাকৃতিক প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি মাত্র। চীনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইতোমধ্যে নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শূন্য অর্থাৎ কার্ভটি ক্রমশ নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে এবং এভাবেই একসময় মহামারিটি বিলুপ্ত হবে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও কমবেশি একই প্যাটার্ন পাওয়া যাবে। তবে দেশগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করবে কার্ভটি কত দীর্ঘ হবে অর্থাৎ মহামারী কোন দেশে কতদিন ধরে চলমান থাকবে।
কোনো মহামারি কীভাবে ছড়ায়?
ভাইরাসজনিত মহামারি ছড়ানো নির্ভর করে ভাইরাসের রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বারের ওপর। রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার যদি শূন্য হয় তবে ভাইরাসটি একজন থেকে অপরজনের কাছে ছড়ায় না। রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার ১ হলে একজন থেকে অপরজনের কাছে ছড়ায়, এই সংখ্যা ২ হলে জিওমেট্রিক হারে ছড়াতে থাকে।
ছবি- বিভিন্ন ভাইরাসের রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার
গাণিতিক সমীকরণ
কোনো অঞ্চলে একটি এপিডেমিক ডিজিজ কিভাবে বিস্তার লাভ করে বিভিন্ন গাণিতিক মডেল দ্বারা সেটি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। নিচের বিভিন্ন প্যারামিটারের মান এক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
ওপরের গাণিতিক সমীকরণকে ডিফারেন্সিয়েশন করতে থাকলে কোনো একটি এলাকায় ভাইরাস ছড়ানোর গাণিতিক রূপ পাওয়া যায়। সিমুলেশনের মাধ্যমে দেখা যায়, ভাইরাসটি কত মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত গ্রাফ একই প্রাকৃতিক প্যাটার্ন অনুসরণ করে।
করোনার ক্ষেত্রেও ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফের পরিণতি পরিশেষে নিম্নমুখীই হবে, তবে বিষয় হচ্ছে আমাদের সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স যতখানি জোরালো হবে কার্ভটি তত দ্রুত নিম্নমুখী হবে। অনেক রোগের ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে এই কার্ভেকে দ্রুত নিম্নমুখী করা যায় কিন্তু করোনার ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক না থাকায় সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংই হচ্ছে একমাত্র ওষুধ।
ছবি - এস ই আই আর মডেল
সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রতিনিয়ত রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত করলেও সেই এপিডেমিক কার্ভকে অন্ততকালের জন্য এক্সপোনেনশিয়াল করে রাখেননি, যাতে মানবজাতির অস্তিত্ব বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। করোনা আমাদের জন্য একটি পরীক্ষা মাত্র। ম্যাথম্যাটিক্যাল প্যাটার্নের মতোই করোনাও একসময় বিলুপ্ত হবে। এটি একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। মাঝের সময়টা কেবল ধৈর্য ধারণের।
আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ এবং মানবিক উপলব্ধিই কেবল এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের হাতিয়ার হতে পারে।
যুগে যুগে মানবসভ্যতায় নগরায়ন বেড়েছে। এই নগরায়নের সাথে সাথে বেড়েছে পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নতুন নতুন রোগ-ব্যাধি। আধুনিকায়নের নামে দূষিত ও অতি জনবহুল পরিবেশ যে কোনো মহামারির বিস্তারের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। শত প্রযুক্তি, ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, মহাকাশ মিশন, ন্যানোটেক, আধুনিক মারণাস্ত্র অথবা অভাবনীয় শক্তির কোয়ান্টাম কম্পিউটার সবই এখন অসহায়। করোনা মানব জাতিকে নতুন করে ভাবনার খোরাক দিয়েছে। আমরা কি আগামীতেও দুর্বল ও অসহায়দের ধ্বংসের উৎসবে মেতে থাকব নাকি একটি মানবিক পৃথিবী গড়ার জন্য নতুন করে পদক্ষেপ নেব?
ফজলে রাব্বী খান, কলামিস্ট ও প্রকৌশলী
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন