‘মূল্যবোধতো আর আইন করে বদলানো যাবে না, নিজ থেকে উৎসাহিত হতে হবে’
আজ আনুমানিক ৫০ দিন পর অনেকটা বাধ্যতামূলক লেন-দেন করতে বাসা থেকে বের হয়ে বুঝতে পারলাম বদলাতে হবে, আমাদের বদলে যেতে হবে। অতি সাধারণ কিছু ঘটনা, তারপরেও মনেহলো আমাকে বদলাতে হবে। যদিও এই জরুরি অবস্থাতে ঘরে বসেই কীভাবে সবধরণের লেন-দেন সম্পন্ন করা যায় তা রপ্ত করে ফেলেছি, মুখ-হাত ঢাকার অভ্যাস এবং অনেকেই অন্য অনেক অভ্যাস বদলে ফেলেছি; কিন্তু আমি এই অভ্যাস বদলানোর পাশাপাশি আমাদের স্বভাব বদলানোকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। স্বভাব না বদলে, শুধু অভ্যাস বদলে ফেললে আসলে “চলো বদলে যাই” হয়না। একটি হচ্ছে আমার চারপাশের পরিবেশের উপর আমার আচরণগত পরিবর্তন, আর অন্যটি হচ্ছে আমার উপর আমার পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব। বদলে যেতে হবে। আমাকে, নিজেকে, আমাদের আশ-পাশ ও অন্যকেও।ভেবেছিলাম অনেক মানুষ বদলে গিয়েছে, অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে, কিন্তু না। প্রত্যেক আমিকেই পরিবর্তনের অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে আরও অনেক সময় প্রয়োজন।
রিকশাওয়ালার কাছ থেকে জানতে পারলাম উনার দৈনিক জমা দুইশ’ থেকে তিনশ’ হয়েছে। ভাড়া দিগুণ দিলাম (দিতে পারলাম)। মন খারাপ হয় উনাদের কথা ভেবে। কোভিড-১৯ এর প্রভাব সমাজে শ্রমজীবী মানুষগুলোকে বেশি কষ্টে ফেলেছে। আমরা সবাই নিজেদের ক্ষতিটা প্রণোদনায় পুষিয়ে নিতে ব্যস্ত, অথবা রিকশাওয়ালার মত কারও ওপরে চাপিয়ে দিয়ে আদায় করে নিচ্ছি। সবাই না হলেও অনেকেই এটা করছি। তাই বলছি বদলাতে হবে। কিন্তুমূল্যবোধতো আর আইন করে বদলানো যাবেনা। নিজ থেকে উৎসাহিত হতে হবে। আমি রিকশাওয়ালাকে যে বাড়তি টাকাটা দিলাম, এমন অনেকেই দেন। এটি আমার কাছে দান। এই জরুরি অবস্থাতে আমার মনে হয় আমাদের সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করার মানসিকতা রাখতে হবে। তাই বলছি “চলো বদলে যাই”।
একটি ব্যাংকের বুথে ঢুকতেই, বয়স্ক মানুষটি বেশ কর্কশ ভাবেই বলল টাকা নেই, ঢুকবেন না। কী সমস্যা, কখন টাকা পেতে পারি; জিজ্ঞেস করাতে উনি বিরক্ত হলেন। আমিও রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে কথা বললাম। পরে বুঝতে পারলাম আমার রাগ করা ঠিক হচ্ছেনা। কোথায় গেল আমার সেই মূল্যবোধ। রাগ হজম করা শিখতে হবে, বন্ধুরা বলত- “রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন”। বদলাতে হবে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ যে আমার একেবারেই নেই, তা নয়। এই গৃহবন্দি অবস্থাতেই ধূমপান থেকে নিজেকে একদমই বিরত রাখতে পেরেছি। জানি না আজ রোজা না থাকলে এই বিরতিটা বজায় রাখতে পারতাম কিনা! কোভিড-১৯ এর ভয় কিনা জানি না, কিন্তু অনেক দিনের বদলে যাওয়ার ইচ্ছা থেকে আপাতত ধুম্রশলাকা থেকে দূরে থাকছি, পারছি। এটাও বুঝতে পারছি, সিগারেট ছাড়াটা মদ-গাঁজা ছাড়া থেকেও কঠিন; অথচ তা দিব্যি বাজারে কিনতে পাচ্ছি, আর জনসম্মুখে খেয়েও যাচ্ছি। বাজার যেন আমাকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং আমি যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সেই চেষ্টায়- ”চলো বদলে যাই”।
এই বুথ থেকে অন্য বুথে রওনা দিলাম অন্য আরেকটা রিকশা নিয়ে। বয়স্ক রিকশাওয়ালা, বাবার বয়সী। উঠতে কষ্ট হচ্ছিলো মনে, তবুও উঠলাম; নামার সময় আবারও বেশি ভাড়া দিলাম। কিন্তু আমিতো এই বাবার বয়সী মানুষটার জন্য কিছু করতে পারলাম না। ভাবলাম, যে শহরে আমার বাবার বয়সী মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণাতে রিকশা চালাচ্ছে, সেই শহরেই বসবাস করে সেই বাবার পিঠেই সওয়ার হয়ে আমি রোজা রেখে সৃষ্টিকর্তা’র সন্তুষ্টি লাভের আশায় ঘুরে বেরাচ্ছি; এ আমি কেমন মানুষ!! আমায় বদলাতে হবে। এ যে অনেক বড় পরিবর্তনের কথা ভাবছি, এটা আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমায় কেউ বলে দিন আমি কী করতে পারি; সৃষ্টিকর্তা আমায় সাহায্য করুন, আমায় ক্ষমা করুন।
রিকশা থেকে নামতেই শুনলাম আর দেখলাম অন্য আর এক রিকশাতে বসে, এক ভদ্রমহিলা চেঁচিয়ে অন্য একজনকে বলছেন, “থাপড়ানো উচিৎ, থাপড়ায়ে এদের সব দাঁত ফেলে দেয়া উচিৎ”। এই আবাসিক এলাকার দারোয়ান দেখলাম ব্যাপারটা সমাধানের চেষ্টা করছেন। মহিলার এমন আচরণের পর আমার তার পোশাক আর তার স্থুলতা চোখে পড়লো। যদিও কারো পোশাক আর স্বাস্থ্য নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কিছু নাই, তারপরেও মনের মধ্যে তার উপর এক ধরনের ঘৃণা দেখা দিল। উনার সামনে স্তুপ করা বাজার, চিৎকার, আর তার শরীর-মুখ ঢেকে রাখা পোশাক কেমন যেন বেমানান লাগতে শুরু করলো। তারপরেও নিজেকে বুঝালাম, আমার মনের এই ঘৃণা কে বদলাতে হবে, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি অন্যায় আর অসুন্দর আচরণ আমি ঘৃণা করতেই পারি বরং যে বা যারা এমন আচরণ করছে তাদেরকেই বদলাতে হবে; “চলো বদলে যাই”।
যখন অন্য আরেকটি বুথে পৌঁছালাম, সেখানেও ঢুকতে পারলাম না। সার্ভার ডাউন। পাশ থেকে কেউ একজন দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো উপরে ব্যাংক খোলা আছে কিনা? দারোয়ান কি বলল বুঝতে পারলাম না কিন্তু আমিও সেই অন্য মানুষটার পেছন পেছন ব্যাংকে ঢোকার চেষ্টা করলাম, আর হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, জানতে চাইলো কোথায় যাচ্ছি, ব্যাংক তো বন্ধ। এবার আর রাগ হলোনা, নিজেকে বোকা মনে হলো। কিন্তু দুই ব্যক্তির দুর্ব্যবহার, আমাকে আবার বিচলিত করলো, করোনাভাইরাস এদের ব্যবহার বদলাতে পারেনাই। তাই আমি নিজেই প্রত্যয় নিলাম মনে মনে, দুর্ব্যবহার করবোনা কখনও, বদলাতে হবে নিজেকেই; ‘চলো বদলে যাই’।
লেন-দেন এর জরুরি কাজটা আর করতে পারলাম না, জানতে পারলাম সেই কথিত ব্যাংকের সার্ভার বিকেলের আগে আর ঠিক হচ্ছে না। বাড়ি ফিরবো বলে রওনা দিলাম, আর পথে মুদির দোকান পেয়ে আমার মেয়েটার জন্য কিছু কিনতে নামলাম। সেখানেও অপ্রত্যাশিতভাবে এক বয়স্ক মানুষ দোকানের ছোট্ট ছেলেটার উপর রেগে গেলেন। ছেলেটা নাকি খুচরা দশ টাকা তাকে জিজ্ঞেস না করেই একজন ভিক্ষুককে দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ছেলেটার বক্তব্য সে বৃদ্ধা’র কথামতই কাজটা করেছে। পরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে রিকশা নিতে গিয়ে দেখি সেই বৃদ্ধই রিকশাওয়ালাকে বেশি ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছেন না। আমি ভাড়া বাড়িয়ে দিতে রাজি হওয়াতে রিকশাওয়ালা চলতে শুরু করলেন। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম, কাজটা আমি ঠিক করলাম না। বৃদ্ধার কাছে হয়তো সেই দশটা টাকাই অনেক মূল্যবান ছিল, যেটা দোকানের পিচ্চি ছেলেটা ভিক্ষুককে না দিয়ে যদি উনার হাতে দিতেন, হয়তো উনি উনার অন্যকোনও প্রয়োজন মেটাতে পারতেন। পূর্বের ঘটনায় বৃদ্ধাকে বিচার করা আমার ঠিক হয়নি। আমাকে বদলাতে হবে, মানুষকে এতো তাড়াতাড়ি বিচার করা যাবে না।
আর তাই নিজেকেই বললাম, চলো বদলে যাই-রাগ, দুর্ব্যবহার পরিহার করি; দান, ক্ষমা, সদাচরণ, সদ্ব্যবহার প্রতিষ্ঠা করি। সবঘটনা যা আমাদের জীবনে ঘটে তা ভালো করে বিশ্লেষণ করি; সম্ভব হলে খেয়াল রাখি, যেন আমাদের অর্থসম্পদ কেবল ধনীদের মধ্যে যেন ঘোরাফেরা না করে।
সাজীব হাসান,
সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন