বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে কোভিড টেস্ট রিপোর্ট সঙ্গে নিয়ে কোনো রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হতে যাওয়া একটি অকল্পনীয় ব্যাপার
করোনাভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সমগ্র বিশ্ব যেমন লাগাতার কাজ করে যাচ্ছে, বাংলাদেশও সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। সরকারি-আধা সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোও সাধ্যমত এই মহামারি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।
যেহেতু, পৃথিবীর সর্বত্র করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের মাধ্যমেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এবং কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে এই রোগটি বাংলাদেশে মহামারি আকারে ছড়িয়েছে, সেহেতু যদি কোনো রোগীর এই মুহূর্তে সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর থাকে তাহলে আমাদের ধরেই নেওয়া উচিৎ যে রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। যদি রোগী স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায় তবে অবশ্যই কোভিড টেস্টের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা না করে হাসপাতালগুলোর উচিৎ রোগীর চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া।
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে কোভিড টেস্ট রিপোর্ট সঙ্গে নিয়ে কোনো রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হতে যাওয়া একটি অকল্পনীয় ব্যাপার। তাছাড়া পিসিআর টেস্টেও ৪০ ভাগ “ফলস নেগেটিভ” রিপোর্ট আসার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং, করোনাভাইরাস একজন আক্রান্ত রোগী যদি ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হয় তবে সেই হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সসহ অন্য রোগীদেরও আক্রান্ত হওয়ার একটি বড় সম্ভাবনা থেকে যায়।
গত ৯ মে, ২০২০ থেকে আমরা ইমপালস হসপিটাল বেসরকারি কোভিড হাসপাতাল হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের করোনাভাইরাস আক্রান্ত সদস্যদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি সাফল্যের সাথে। এ পর্যন্ত আমরা ৯৪৪ জন পুলিশ সদস্যসহ ১১৫১ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছি যাদের অধিকাংশই সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন। এছাড়াও নন-কোভিড রোগীদেরকেও আমরা চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার শুরু থেকে এ পর্যন্ত একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি ব্যতীত আমাদের হাসপাতালের কেউ সংক্রমিত হননি।
এর মাধ্যমেই বোঝা যায় এই করোনা সময়ে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে আমরা যেসব ব্যবস্থাপনা নিয়ে রোগীদের সেবা করে যাচ্ছি তা সঠিক হিসেবেই বিবেচনার দাবিদার।
প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা কোভিড আক্রান্ত অথবা কোভিড সাসপেক্টেড রোগীকে আমাদের হেল্পলাইনের মাধ্যমে বাসায় রেখেই চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকি। যদি রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে তখন আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলি। একজন কোভিড পজিটিভ রোগীকে আমরা সরাসরি হাসপাতালের “রেড জোনে” ভর্তি নিয়ে নেই।
কোভিড-১৯ টেস্ট রিপোর্ট না থাকলে, রিপোর্ট পেতে দেরি হলে অথবা প্রাথমিক রিপোর্ট নেগেটিভ আসা রোগীদের আমরা হাসপাতালের “কোভিড সাসপেক্ট” জোনে (ইয়োলো জোন) ভর্তি করি। এটা “কোভিড পজিটিভ” অর্থ্যাৎ রেড জোন থেকে আলাদা।
যখন রোগীর একাধিক কোভিড টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ আসে এবং অন্যান্য সমস্যা থেকেও তিনি সেরে ওঠেন তখন আমরা তাকে রাখি গ্রিন জোনে। তিন ধরনের জোন ব্যবস্থা চালু রাখার কারণে এই হাসপাতালে যেমন রোগীদের থেকে অন্যদের সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা একেবারেই কম থাকে, পাশাপাশি ডাক্তার-নার্সসহ অন্যান্য কর্মীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রোগীদের সেবা করতে সক্ষম হন।
যেহেতু, বর্তমান বাস্তবতায় অধিকাংশ রোগীই কোভিড পজেটিভ হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তাই ইমপালস হাসপাতাল এই মুহূর্তে ২৫০ বিছানার অধিকাংশ জায়গা রেড জোন হিসেবে বরাদ্দ রেখেছে।
বাংলাদেশের যে সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা আইসোলেশন ওয়ার্ড-অক্সিজেন এবং আনুষঙ্গিক চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, সেই সঙ্গে জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ/এইচডিইউ সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব সেসব হাসপাতাল চাইলেই চিকিৎসা কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ও জোন ভাগ করে কোভিড ও ননকোভিড রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে।
ইমপালস হাসপাতালে উল্লেখিত সকল পরিসেবা থাকার কারণে কোভিড আক্রান্ত ও অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা কম হচ্ছে। এছাড়াও, যেসব রোগী অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তাদের জন্য অত্যন্ত দক্ষ আইসিইউ পরিচালনাকারী টিমের সমন্বয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ৫৬ বেডের আইসিউ/এইচডিইউ ইউনিট ও সার্বক্ষনিক মনিটরিং, ভেন্টিলেটর/হাই ফ্লো নজেল ক্যানোলা ইত্যাদি ব্যবস্থা নিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য এই বিশেষায়িত হাসপাতাল সার্বক্ষণিকভাবে তৈরি আছে।
একজন অত্যন্ত জটিল অবস্থায় থাকা করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর জীবন ফিরে পাবার গল্প এক্ষেত্রে আলোচনা করছি বিশেষজ্ঞ আইসিইউ টিম ও আইসিইউ ব্যবস্থা একজন জটিল রোগীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তা বোঝানোর জন্য। কিছুদিন আগে গভীর রাতে ৬৫ বছর বয়সী এক নারীকে তার স্বজনরা ইমপালস হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে ভর্তির জন্য নিয়ে আসেন। যার ওজন ১৩০ কিলোগ্রাম। ডায়াবেটিক, উচ্চরক্তচাপ, হার্ট এবং কিডনির জটিলতা নিয়ে তিনি আগে থেকেই ভুগছিলেন। রোগী একজন ডাক্তার এবং তার ডাক্তার স্বামীর মাধ্যমে তিনি কয়েকদিন আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের একটি প্রথম সারির হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে তিনি যখন ইমপালসে আসেন তখন তার জীবন অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ছিল।
জরুরি ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে আইসিইউতে রোগীর সেবা দেওয়া শুরুর আগেই রোগী কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট করেন, কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে সে অবস্থা থেকে রোগীকে কিছুটা ভালো করার পর থেকে ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিক এর চিকিৎসা ও পাশাপাশি কিডনির চিকিৎসার জন্য ডায়ালাইসিসেরও প্রয়োজন হয়। একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি, দক্ষ নার্স ও আধুনিক আইসিইউ ব্যবস্থার কারণে রোগীকে ধীরে ধীরে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হয়।
এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, রোগী যদি একবার মাল্টি-অর্গান ফেইলিওর এ চলে যায় তা হলে সেখান থেকে জীবন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ থাকে। কাজেই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী যেন মাল্টি-অর্গান ফেইলিওর এর দিকে না যায় সেই জন্য যে কোন নতুন সমস্যা তাৎক্ষণিক সনাক্তকরণ এবং সেই ব্যাপারে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া এবং সেই মোতাবেক চিকিৎসা দেওয়া সকল ধরনের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটগুলোর জন্য অত্যন্ত জরুরি।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার। পক্ষান্তরে দেশের মোট জনসংখ্যার কমবেশি ১৭ ভাগ মানুষ সর্দি, কাশি, গলা ব্যথ্যা, শ্বাসকষ্ট, জ্বরসহ অ্যালার্জি রাইনাইটিস রোগে আক্রান্ত। তাহলে আমরা ধারণা করতেই পারি যে, কত বড় একটি সংখ্যার মানুষ দেশে কোভিড উপসর্গের কাছাকাছি উপসর্গ নিয়ে রোগাক্রান্ত কিন্তু তারা কোভিড পজিটিভ নন। এছাড়াও হার্ট-কিডনি-নিউরোসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগী রয়েছেন, তাদের মধ্যেও করোনাভাইরাসে লক্ষণ থাকতে পারে কিন্তু তারাও কোভিড নেগেটিভ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সকল রোগীরা অনেকেই বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে রাস্তায় মারা যাচ্ছে, আবার হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় সেই ভয়ে বাড়িতে বসে চিকিৎসা না নিয়ে প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছেন এবং অনেকে মারা যাচ্ছেন।
সুতরাং দেশের এই সঙ্কটাপন্ন সময়ে যেসব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ব্যবস্থা রয়েছে তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হাসপাতালকে জোনভিত্তিক ভাগ করে সব ধরনের রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া উচিৎ। ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানুষের সেবা করা এখন খুব বেশি কঠিন হওয়ার কথা নয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সমন্বিত সাহসী উদ্যোগের ফলে দেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী যারা শরীরে মারাত্মক ব্যাধি নিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন তাদের জন্য অন্তত চিকিৎসার অধিকারটুকু নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
অধ্যাপক ডা. জাহীর আল-আমিন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইমপালস হাসপাতাল
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন