বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, আলাপ আলোচনায় কেবল ইংলিশ ভাষা ব্যবহার করলে সে এলিট হয়ে গেলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমাজকে এই ভুলটি ভীষণভাবে ভুগিয়ে চলেছে
মানুষ সামাজিক জীব। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এটি নতুন করে আলোচনার কোনো বিষয় নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আধুনিক এই সময়েও আদিমকালে সৃষ্ট সামাজের নানান স্তরের বৈষম্যমূলক প্রথার চর্চা এখনও চলে আসছে।
সমাজের এই বিভাজনগুলো কতকগুলো নিয়ামক যেমন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যার ফলে একটা সমাজ ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির উদ্ভব হয়। দুঃখের বিষয় হল, এটি এখানেই শেষ হয়েও হয় না। আবার এইসব সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির মধ্যে একটা করে এলিট চেতনায় বিশ্বাসী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। যাদের সংজ্ঞা "এলিট" এর আক্ষরিক অর্থের একেবারে পরিপন্থি!
এই এলিট শ্রেণি দাঁড়ানো থেকেই সমস্যার শুরু এবং বলতে গেলে এটাই সমস্যার গোড়া।
বিষয়টি খুবই বিস্ময়কর। কারণ আমরা মনে করি, একজন লোকের বিশাল একটি বাড়ি থাকলে, গুটি কতক গাড়ি থাকলে, ব্যাংক ব্যালেন্স থাকলে, উড়োজাহাজে বিজনেস ক্লাসে ওড়াউড়ি করলে, একটা ফর্সা বউ থাকলে, আলাপ আলোচনায় কেবল ইংলিশ ভাষা ব্যবহার করলে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে কিংবা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া বাচ্চাকাচ্চা থাকলে, লিভিং রুমটি নানা দেশ থেকে আনা শো-পিসে পূর্ণ থাকলে, লোকটি গলফ খেললে, আর স্ত্রী স্পা নিতে গেলেই সে এলিট হয়ে গেলো।
এই ভুলটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমাজকে ভীষণভাবে ভুগিয়ে চলেছে। যে বর্ণনাটি দিলাম, এটিকে কেবল "এফলুয়েন্স"ই বলা যায়। শিল্প-বিপ্লব যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ায় ঘটেনি, তাই দুর্নীতি-বিপ্লবোত্তর এই নব্য ধণিক সমাজটিকে বড় জোর "ক্যাপিটালিস্টিক" বলেই অবিহিত করা যায়।
“বেংলিশ” ও “মিংলিশ” বলা সন্তানাদি নিয়ে গর্বিত এইসব মানুষের আচার-আচরণ এখন অনেকটাই সংস্কৃতি বর্জিত। যে শেকড় থেকে রস শুষে তাদের শেকড় হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে সেই গোড়াকেই তারা অস্বীকার করে! সুতরাং এরা এক গভীর আত্মপরিচয়হীনতায় ভুগে থাকেন।
এলিটিজমের আলোচনায় প্রথমেই বলবো ধর্মের কথা। আমাদের সমাজে অনেক ধর্মের মানুষই আছেন। বিশেষত মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এদের সংখ্যাটিই বেশি। এরা হল আস্তিক মতাদর্শের গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সে অর্থে নাস্তিকতাও একটি বিশেষ মতাদর্শের গোষ্ঠীর কাতারেই পড়ে। একটা মানুষের ধর্ম-বিশ্বাস যেটাই হোক না কেন তার সকল ধরনের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের অধিকার যেমন আছে,পাশাপাশি এইসব সম্পাদনে তার একটি দায়িত্ববোধও অনুভব করা উচিত।
একজন মানুষের কোনও কাজে তার ধর্মীয় পরিচয় কি, এমন প্রশ্ন না আসাটাই উচিত নয় কি? কিন্তু আমরা কি বাস্তব সমাজে এমনটি দেখতে পাই? বিভিন্ন এলাকায় কিংবা দেশে যেই ধর্মের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা চেতনায় অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠীর লোকজন থেকে এলিট এবং তাদের দ্বারা প্রায়শই অন্যান্যদের অত্যাচারিত হতে দেখি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অত্যাচারিত হওয়ার ঘটনা আমরা অনেক দিন ধরেই দেখে আসছি। ভারতে বর্তমানে এই সমস্যাটি একদম অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
এবার আসি লিঙ্গের কথায়। লিঙ্গ হিসেবে আমরা কেবল নারী, পুরুষকেই চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এর বাইরে আমরা ভিন্ন লিঙ্গ সত্ত্বার মানুষকে একরকম অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে রাখতেই বোধহয় অধিক সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সুতরাং আমাদের এই সমাজে নারী-পুরুষ লিঙ্গ সত্ত্বার বাইরে বাকি সবাই সংখ্যালঘু (মাইনরিটি)!
এ বিষয়ে আপনার বিবেককে প্রশ্ন করুন। সমাজে সব লিঙ্গের মানুষদের সমান অধিকার থাকার কথা, সেটাই তো হওয়া উচিত, তাই নয় কি? কিন্তু না, আমাদের সমাজে লিঙ্গের ক্ষেত্রে এলিট শ্রেণি হল পুরুষ! কেবল সমাজ একাই যে পুরুষদেরকে সর্বেসর্বা ঘোষণা করেছে, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন ধর্ম বিশেষত ইসলাম সমাজের সব লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের মধ্যে কেবল পুরুষকেই সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রে রেখেছে।
সুতরাং আমাদের সমাজ হল একটি পুরুষতান্ত্রিক কিন্তু নারীবিদ্বেষী সমাজব্যবস্থা। এই সমাজব্যবস্থার সংকীর্ণতায় তাই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় যৌন সংখ্যালঘুরা কোনো স্থানই পায় না। সুতরাং সমাজ হতে লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় যৌন সংখ্যালঘুদের একরকম ধরাছোঁয়ার বাইরেই রাখা হয়। যদিও ইদানীং আমাদের দেশে হিজরাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সমাজের মাথামোটা শাসকশ্রেণি বোধহয় জানেনই না হিজরারা হল লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় যৌন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কেবল একটি বিশেষ সংস্কৃতির সম্প্রদায় মাত্র, এটা কোন লিঙ্গ পরিচয় না! সুতরাং একজন লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় যৌন সংখ্যালঘু শৈশব থেকেই চরম একাকীত্বে, সামাজিক অবহেলায় আর এক প্রবল মানসিক যন্ত্রণায় বড় হতে থাকে। এখন যদি সেই সমাজের একটি দৃশ্যমান অংশ নারীকে সামনে রাখি তবে দেখবেন, সেখানেও এই পুরুষতান্ত্রিকতার যাঁতাকলে একজন নারী পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কম মূল্যায়িত এবং অত্যাচার, নিপীড়নের শিকার হন। শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবারে শুধু মেয়েরা কাজ করবে, মেয়েদের স্থান রান্নাঘের, এমন একটা ভাব। অনেক পরিবারে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স/গৃহ নির্যাতন অর্থাৎ সোজা কথায় বউ পেটানোর কথাতো আমরা শুনে থাকি। আর মানসিক নির্যাতন এবং মতের গুরুত্ব না দেওয়া তো আছেই।
এরপর আসে সমাজ; সমাজে হাজার হাজার "এক্সকিউজ" দেখিয়ে খুন, ধর্ষণ, ধর্ষণ করে খুন এসবকে হালাল করার একটা নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে এবং সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল এসব "এক্সকিউজ" দেখিয়ে সমাজের একদল মানুষ এসব জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। "ছোট কাপড় পরেছে অথবা হিজাব নাই কেন, ওড়না নাই কেন, বোরকা নাই কেন? তার মানে তাকে ধর্ষণ করা জায়েজ আছে!", "বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেক্স করছে কেন? তার মানে ধর্ষিত হতে চাচ্ছে", "প্রেমের প্রস্তাব বর্জন করেছে কেন? সে ভুলে গেছে, পুরুষ যা বলবে তাই করতে হবে। তার মানে তাকেও ধর্ষণ করে খুন করার জায়েজ আছে!" ধর্ষণ বা খুন করা বাদেও আমরা এরকম অনেক "এক্সকিউজ" দেখতে পাই। "আরেহ পিরিয়ড তো লজ্জার জিনিস। ছিঃ ছিঃ, এটি কোনো আলোচনার বিষয় নাকি?" এসব নিয়ে কথা বলছে মানে তাকেও এই পুরুষতান্ত্রিকার শিকার হতে হবে!
এবার আসি বর্ণের কথায়। চামড়ার রং কালো মানে যে খারাপ, সাদা মানে যে ভালো, দেখতে আকর্ষণীয় সুদর্শন, এটা একপ্রকার আমাদের মাথায় ঢুকিয়েই দেওয়া হয়। মানে এটা সমাজে একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এইজন্য আমরা ভারতীয় উপমহাদেশে "ফেয়ারনেস" ক্রিমের অত্যাধিক ডিমান্ড দেখতে পাই। কারণ সাদা মানে তো ভালো, সাদা মানে তো সুদর্শন আর এলিট। তাই সবাই সাদা হতে চায়। এরপর সমাজে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যতো দেখতে পাই-ই আমরা। যেমন স্কুলে "ওই কাইল্লা, নোংরাটার সাথে কেউ মিশবি না" থেকে শুরু করে "এহ হে ভাবী, বউ কিংবা জামাইটা এতো কালো কেন?" তবে এগুলো আমাদের সমাজের অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার-স্যাপার। এরপর যেটা না বললেই নয়, বর্তমানে আমেরিকার বর্ণবাদের ঘটনা আমরা সবাই জানি। আসলে বর্ণবাদ সবসময়ই ছিলো এবং অনেক খারাপভাবেই ছিলো। বর্তমানে আমরা যেটা দেখছি সেটাই সহ্যক্ষমতার বাইরে।
সমাজের এই হীন এলিটিজমের আরেক দৃশ্য ধরা পরে কারোর পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
কে কোন পোশাক পরবেন, সেটি অবশ্যই তার ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়। কিন্তু পশ্চিমা পোশাককে কেউ যখন স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করবেন, তখন সেটিকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখবেন? আবার সৌদি পোশাক পরে সেটিকে কেউ যখন ‘শুদ্ধতা’র কিংবা 'পবিত্রতা'র মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন, তখন আমরা তাকে অবশ্যই আত্মসংস্কৃতি বিমুখ অপভ্রংশ মানুষের কাতারেই ফেলবো।
নিজস্ব সংস্কৃতিতে আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছাড়া কাউকে এলিট বলে মেনে নিতে কারোর ভীষণ রকম আপত্তি থাকা উচিত। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার মানুষকে তখনই আপনার সঙ্গে খুব আগ্রহভরে মিশতে দেখবেন, যখন নিজস্ব পোশাকে তার সামনে দাঁড়াবেন। পোশাক ব্যাপারটা এখানে প্রতীকী। তবে এটিই হবে আপনার আত্মবিশ্বাস আর মৌলিকত্বের প্রতীক।
এফলুয়েন্সের সঙ্গে এলিটিজমের আসলে কোনো সম্পর্কই নেই। এলিটিজমের সম্পর্ক 'এনলাইটেনমেন্টে'র সঙ্গে। এই এনলাইটেনমেন্ট খুব বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই যে আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জীবনের স্কুল থেকেই আসল এলিটিজমের উদ্ভাস ঘটে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো এফলুয়েন্স অনেক লোকের ছিলো। কিন্তু তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো এলিট হতে পারেননি। অন্তর্গত আলোকায়নের কারণে লালন এবং লেনিন উভয়েই এলিট। যারা পৃথিবীর সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূগোলে জন্মেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম সেই অর্থে এফলুয়েন্স ছিলেন না, কিন্তু তিনি এলিট। কারণ তাঁর মধ্যে বিশ্বদৃষ্টি তৈরি হয়েছিলো।
এইসব কথা উত্থাপনের অভিলক্ষ্য সেইসব তরুণেরা—যারা এফলুয়েন্সকে এলিটিজম ভেবে ভুল-এলিট হওয়ার দুর্মর চেষ্টা করে থাকেন। চিন্তার জগতের আলোকায়নই এলিটিজম। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বদ্ধচিন্তার বাইরে মানবিক মুক্তভাবনাই হল এলিটিজম।
অমুক ভাই-তমুক আপার গাড়ি, তাদের প্রসাধন কক্ষের দামি টাইলস বা কমোড, কিংবা চার্লিদের নিয়ে বার্থডে কেক কেটে সেলফি তোলা, চুলে জেল দেওয়া বড় ভাইদের জীবনটা আসলে ওই কমোডের মতোই। যেটা ফ্ল্যাশ করে দিলেই নেমে যাবে তাদের উপজীবনের বর্জ্য।
ইসলামুল আলম প্রান্ত
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।
মতামত দিন