শহীদ লে. সেলিম ১৯৪৮ সনে যশোরের অভয়নগরের এক সম্ভ্রান্ত চিকিৎসক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন
প্রতি বছর ৩০ জানুয়ারি মিরপুর মুক্তি দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭২-এর এই দিনে মিরপুরকে মুক্ত করতে যেয়ে লে. সেলিম ৪১ জন সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ বেশ কিছু পুলিশ এবং মুক্তিযোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ৩০ জানুয়ারি দিনের শেষভাগে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে লে. সেলিমই যুদ্ধ পরিচলনা করে মুক্ত করেন অবরুদ্ধ মিরপুর। ৩০ শে জানুয়ারি ৭২-এর সারাটা দিন এবং সন্ধ্যে পর্যন্ত নিজের শেষ রক্তবিন্দুটুকু ঝড়িয়ে যুদ্ধ করে বিজয়ের পথ খুলে দেন সেলিম। এভাবেই ৩১ জানুয়ারি প্রভাতে মুক্ত হয় অবরুদ্ধ মিরপুর।
বেলা ১০-১১টা বুকে বুলেট বিদ্ধ হবার পর আঘাত নিয়েও সম্মুখসমরে লে. সেলিম যে অসাধারণ সাহসিকতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে গেছেন তা তাঁর সহযোদ্ধারাই বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন।
এই অসাধারণ বীর যোদ্ধা এবং তার ভাই লে. আনিস (ডা. এম এ হাসান) ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকার তেজগাঁয়ে ১ প্লাটুন পুলিশ সদস্য নিয়ে যে যুদ্ধ শুরু করেন তা পরিণত সমরে পরিণত হয় ১৯৭১-এর ১৪ এপ্রিল লালপুর আশুগঞ্জে। ওই দিনে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করে লে. সেলিম যে সাহসী সমর অভিযাত্রা শুরু করেন তা ৭১-এর নয় মাসে কখনও থেমে থাকেনি। তেলিয়াপাড়ার প্রতিরোধ যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বার বার পরাভূত করেছেন লে. সেলিম। সিলেটের হরশপুর ও নোয়াখালীর বেলোনিয়া-পরশুরাম মুক্তকরণ অভিযানে তিনি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির সহযোগী হিসাবে যুদ্ধ করেছেন। এ যুদ্ধে তিনি পাকিসেনাদের সাথে হাতাহাতি সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়েছিলেন তা উলেখ করেছে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৪র্থ বেঙ্গলের মেজর দিদার। ৪ ডিসেম্বর আখাউড়া যুদ্ধে লে. বদি শহীদ হলে লে. সেলিম দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভো কোম্পানীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আখাউড়া যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
অথচ এই বীর যোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন আজও হয়নি। যুদ্ধে শহীদ হলে বীর যোদ্ধা শহীদ লে. সেলিমকে শীর্ষ সম্মানে ভূষিত করার কথা ছিল, একটি মূখ্য রাস্তার নামকরণ করার কথা ছিল তার নামে। এর কিছুই হয়নি।
ব্যর্থতা ও গ্লানিতে নিমজ্জিত কিছু অক্ষম ব্যক্তিগণ মুছে ফেলতে চেয়েছিল মিরপুর মুক্তকরণের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে। অমার্জনীয় অবহেলায় তারা ফেলে এসেছিল নিজ সেনা ও সাথীদের মৃতদেহকে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ৩০ বছর পর ১৯৯৯-এ মিরপুরের মুসলিম বাজার ও জলাদখানায় শহীদদের হাড়গোড় ভেসে উঠে তাদের ত্যাগ, বিসর্জন ও বীরত্বের কথাকে ব্যক্ত করে সত্যকেই উন্মোচিত করেছে।
স্বাধীনতার ৪১ দিন পর মুক্ত বাংলাদেশের বুকের কোণে অবরুদ্ধ মিরপুরে দলছুট পাকিস্তানি সেনাসহ আলবদর বাহিনী তথা বিহারী মুজাহিদ কর্তৃক আত্মসমর্পণ চুক্তি ও জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গ করে বাঙালি সেনাদের ওপর ঐ আক্রমণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পাকিরা বাংলাদেশের মাটিতে পরাভূত হবার পরেও এদেশকে তাদের করায়ত্ব রাখবার জন্য যে অশুভ পরিকল্পনা ও অভিলাষ পোষণ করছিল এবং বিজয়ীর প্রতি যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করছিল ওই দিন মিরপুরে সংঘটিত ঘটনা ছিল তারই একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে লালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন সেলিম ও আনিস ভ্রাতৃদ্বয়। এই যুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার হিসাবে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন সেলিম। ১৪ এপ্রিল বিকালে পাকিস্তানি বাহিনী জল, স্থল ও আকাশ পথে আক্রমণ শুরু করলে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে শাহবাজপুরে ফিরে আসেন সেলিম। এরপর শাহবাজপুর, নাসিরনগর, শাহাজিবাজার, তোলিয়াপাড়াসহ অসংখ্য যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন সেলিম ও আনিস ভ্রাতৃদ্বয়। সিমনা বিওপি কেন্দ্র করে ২য় বেঙ্গলের সদস্য হিসাবে তারা অসংখ্য যুদ্ধে অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করে ব্রিগেডিয়ার পান্ডের নজর কারেন এবং শীর্ষ পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিবার্চিত হন। এই দুই ভ্রাতা পাকিস্তানের জন্য ত্রাস সৃষ্টি করে ভারতীয় মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর কাড়েন। তাদেরকে নিয়ে ডকুমেন্টরি ছবি তৈরি করে এবিসি টেলিভিশন। জুলাইয়ের শেষে ভারতে যে ৬১ জন অফিসারকে ট্রেনিং দেওয়া হয় তারা তাতে নির্বাচিত হন। এতে মেধা তালিকায় শীর্ষদের মধ্যে স্থান করে নেন সেলিম। অক্টোবরের ১৮ তারিখে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের যোগ দিয়ে সেলিম বেলোনিয়া যুদ্ধে শরিক হন।
ফুলগাজী বেলোনিয়া, হরষপুর, মুকন্দপুর মুক্ত করে সেলিম যখন ব্যাটালিয়নের হেড কোয়ার্টারে ফিরে আসেন তখন আখাউড়া যুদ্ধে ভ্যানগার্ড কোম্পানিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তার অনুজ লে. আনিসুল হাসান (ডা. এম এ হাসান)। ৪ঠা ডিসেম্বর ওই যুদ্ধে লে. বদি শহীদ হলে ২য় ইস্ট বেঙ্গল এর ব্রাভো কোম্পানির দায়িত্ব নেন সেলিম। এরপর শুধু বিজয় আর বিজয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্টের প্রথম গার্ড কমান্ডার। ওই পদে থাকাকালে ৩০ জানুয়ারী ১৯৭২ অবরুদ্ধ মিরপুর মুক্ত করতে তাকে মিরপুরে নেয়া হয়। একটি অসম এবং অতর্কিত যুদ্ধে প্রাণ দেন লে. সেলিম। বীর সেনা এবং মুক্তিযোদ্ধার সম্মান তথা দায়িত্বকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে একজন প্রকৃত বীরের মত যুদ্ধ করতে করতেই শহীদ হন লে. সেলিম।
শহীদ লে. সেলিম ১৯৪৮ সনে যশোরের অভয়নগরের এক সম্ভ্রান্ত চিকিৎসক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শৈশব থেকেই গণিতে ছিল তার অসাধারণ মেধা। যুদ্ধে যোগদানের পূর্বে তিনি রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন। সেখানে তিনি কেবল একজন আপসহীন ছাত্রনেতাই ছিলেন না, সেই সাথে একজন অসাধারণ এ্যাথলেট ও কৃতি খেলোয়ার হিসাবে কলেজ ও বিভাগীয় পর্যায়ের অধিকাংশ ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
২৭ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদল্যায় আহতÑনিহত শিক্ষকদের উদ্ধার অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেলিম ও আনিস ভ্রাতৃদ্বয়।
২৭ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের জগন্নাথ হলের নিকট থেকে অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবসহ তার পালিতা কন্যা শহীদ সেলিমের আপন খালা রোকেয়া বেগম এবং খালু মোহাম্মদ আলীকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন এবং আহত-নিহত শিক্ষকদের প্রতি সাহায্যের হাত বড়িয়ে দেন। উল্লেখ্য, ওই দিন ২৫ মার্চ রাতে আমার খালু মোহাম্মদ আলী ও ড. জেসি দেব নিজগৃহে পাকিস্তানিদের হাতে শহীদ হন। এ কাজ করতে গিয়ে প্রায় বন্দি হন পাকিস্তানিদের হাতে।
১৯৭১-এ ৩১ মার্চ ভৈরবে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুক্ত হলেন সেলিম।
১৯৭১-এর জুনের শেষে এবং জুলাই এর শুরুতে ভারতের মূর্তিতে শহীদ লে. সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান প্রথম শট কোর্স গ্রহণ করেন এবং ৯ অক্টোবর ১৯৭১ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। জুলাইয়ের শেষে ভারতে যে ৬১ জন অফিসারকে ট্রেনিং দেওয়া হয় তাদের মধ্যে মেধা তালিকায় শীর্ষদের মধ্যে স্থান করে নেন শহীদ লে. সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান। অক্টোবরের ১৮ তারিখে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের যোগ দিয়ে শহীদ লে. সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদকে নিয়ে বেলোনিয়া যুদ্ধে শরিক হন। ফুলগাজী, পরশুরাম, হরষপুর, মুকুন্দপুর ও বেলোনিয়া মুক্ত করে সেলিম ১লা ডিসেম্বর ’৭১ ব্যাটালিয়নের হেড কোয়ার্টারে ফিরে আসেন। ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১-এ আখাউড়া যুদ্ধে লে. বদি শহীদ হলে ২য় ইস্ট বেঙ্গল এর ব্রাভো কোম্পানির দায়িত্ব নেন সেলিম। এরপর শুধু বিজয় আর বিজয়।
শহীদ লে. সেলিম এমন এক মায়ের সন্তান যার স্বপ্নে ছিল দ্রোণাচার্যের মত এক সাহসী যোদ্ধা এবং বিবেকানন্দের মত এক বোদ্ধা। তিল তিল করে জমানো নানা স্বপ্ন আর অফুরন্ত ভালোবাসাকে বুকে ধারণ করে বুদ্ধি ও প্রাণ চাঞ্চল্যের মিশেল চাইলেন মা তার সন্তানের মাঝে। তিলে তিলে স্নেহ ও ভালোবাসায় গড়া এমন একটি সন্তান তার কোলে এল ১৯৪৮ সনে। মেধা, বুদ্ধি, ক্রীড়াকৌশল, সাহস, শৌর্য্য ও বীর্যে অপূর্ব হওয়া সন্তান তার নানা কাজের মাঝে জয় করে নেয় সবার প্রাণরুতে তৈরি সেই নক্ষত্র প্রিয় মাকে আরো গভীর অশ্রুস্রোতে ভাসিয়ে চিরতরে অপসৃয়মান হলেন ১৯৭২-এর উষালগ্নে মিরপুরের রক্তস্নাত যুদ্ধ প্রাঙ্গণে। অকালে সমাপ্ত হল অসাধারণ সম্ভাবনাময় এক অভিযাত্রা। এতে প্রথম প্রথম সহানুভূতির হাত বাড়ালেও মুক্তিযোদ্ধা সেলিমের মা-এর প্রতি ফিরে তাকানোর অবকাশ আর কারো রইল না। গভীর নিশিথে লাখো শহীদের কান্না শিশিরের মত ঝরে, অলস দুপুরে তাদের দীর্ঘশ্বাস হাওয়া হয়ে ফিরে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। কথামালা ও কিছু গান আর ছবির ফ্রেমে বাঁধা হয়ে রইলেন শহীদ লে. সেলিম ও তাহারা।
কেবল স্মৃতি হয়ে রইলো সেলিম এবং তার মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি। ডায়েরির পাতায় ব্যক্ত সেলিমের দেশপ্রেম ও মাতৃভক্তি কাউকে আন্দোলিত করবে কিনা কে জানে! তিনি লিখেছিলেন-
“১৮/১০/৭১
মাগো,
অনেক দিন পর তোমার কাছে কিছু লিখার সময় হোল। মা তিন মাস ফ্রন্টে থাকার পর ট্রেনিং-এ গিয়েছিলাম আবার সেই একই ফ্রন্টে ফিরে এলাম। ট্রেনিং-এ থাকার সময় প্রত্যেকটি রাতে তোমার কথা ভাবতাম বিশেষভাবে সেই তারায় ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। মনে হত সেই একই আকাশ কিন্তু মা তোমার সাথে কত দুরত্ব! মাগো ছয় মাসের বেশী তোমার মুখ দেখিনা। যখন তুমি আমাদের বিদায় দিলে- আমার শুধু সেই ক্ষণটার কথাই মনে পড়ে যখন তোমার কথা ভাবি। তোমাকে ও বাবাকে ছেড়ে আসতে আমারও কষ্ট হচ্ছিল তাই, গেট থেকে বেড়িয়ে আর পিছন ফিরে তাকাইনি।
আজকের এই দিনে নতুন সেক্টরে ফিরে আসার দিনে, আমার নতুন দায়িত্ব নিতে আসার দিনে, তোমার আর্শীবাদ চাই। মা সে সময় তুমি বলেছিলে শীগগিরি তোদের সাথে দেখা হবে- সেই স্বাধীন দেশে সেই দিনটা যেন কাছিয়ে আসে সেই আর্শীবাদ করো। আমার প্রাণ দিয়েও যেন আমার দায়িত্ব পালন করতে পারি। আর্শীবাদ করো।
সেলিম
৩০/১১/৭১
মা,
পহেলা নভেম্বর নোয়াখালীতে যাবার হুকুম হলো। ফেণীর বেলোনিয়া ও পরশুরাম মুক্ত করার জন্য। ৬ই রাতে চুপচুপ করে শত্রু এলাকার অনন্তপুরে ঢুকলাম। পরদিন সকালে ওরা দেখল ওদেরকে আমরা ঘিরে ফেলেছি। ৮ই রাতে ওই জায়গা সম্পূর্ণ মুক্ত হলো। শত্রুরা ভয়ে আরো কিছু ঘাটি ফেলে পালিয়ে গেল। পরদিন চিতোলিয়া আমরা বিনাযুদ্ধে শত্রু মুক্ত করলাম। আস্তে আস্তে আরো এগিয়ে গেলাম। ২৭ শে যখন আমরা ওই এলাকা থেকে ফিরে এলাম তখন আমরা ফেণী মহাকুমা শহর থেকে দেড় মাইল দুরে ছিলাম, পাঠান নগর ছিল আমাদের অগ্রবর্তী ঘাটি। শীঘ্রই মাগো আবার তোমার সাথে দেখা করতে পারব ভেবে মনটা আনন্দে ভরে গেল।
জান মা, এই যুদ্ধে আমরা ৬০ জন শত্রু ধরেছি। আমাদের কোম্পানীর ৩জন শহীদ ও একজনের পা মাইনে উড়ে গেছে। দোয়া করো মা।
সেলিম”
আনুমানিক সকাল ১১টায় কাঠাঁল গাছের পেছন থেকে ছোড়া প্রথম গুলিটি গাছের পাতা ভেদ করে সেলিমের ডান বুকে লাগে। মোর্শেদসহ অন্যান্য সেনাগণ সেলিমের হা হয়ে যাওয়া পিঠের ক্ষত দেখে ভয় পেয়ে যায়, তারা তাঁর পেছনে ছিল। কখন তারা সরে যায় জানা যায়নি। সুবেদার মোমেনসহ কিছু সৈনিক শেষ পর্যন্ত সেলিমের সাথে ছিল, এদের মধ্যে যারা বেঁচে যায় তাদের কেউ কেউ এ ঘটনা তাঁর ভাই লে. আনিস এবং সুবেদার বার্কিকে জানায়।
আর তার মা ঘটনার বিবরণ ও শেষ কথা বলেন এভাবে শত্রুর শেষ ঘাঁটি মিরপুর। ভীষণ শক্ত ঘাঁটি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার এই উপশহরটিতে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী ও অবাঙালি রাজাকাররা দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর ছিল অবরুদ্ধ। সেখানে পাকিস্তানি পতাকা উড়েছে। সেই মিরপুর অপারেশনে সেলিমকে কে যেন ডেকেছিল। এটা শুনেছি সেলিমের ড্রাইভার আবুল নামে এক সৈনিকের কাছ থেকে। তার বাড়ি ছিল পাবনা।
সেলিম তখন বঙ্গভবনে থাকত। সেখান থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে ত্রিশে জানুয়ারি সকালে মিরপুর যায়। ঐদিন সকাল থেকেই মিরপুর উত্তপ্ত ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মিরপুরে অবাঙালিরা স্থানীয় বাঙালিদের জবাই করছিল। প্রতি রাতে সেখান থেকে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যেত। সেলিম তার বাহিনীসহ বারো নম্বরের ভেতরের দিকে পানির ট্যাঙ্কের কাছে অবস্থান নিয়েছিল। শুনেছি ওখান থেকেই মূল যুদ্ধ শুরু হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার ও অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে এই যুদ্ধ চালায়। ন’মাস ধরে মিরপুর ছিল অবাঙালিদের মিনি ক্যান্টনমেন্ট। প্রচুর অস্ত্রসস্ত্র মজুদ ছিল সেখানে। হানাদাররা এই অস্ত্রসস্ত্রের বলেই অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সেলিম গুলিবিদ্ধ হলে নিজের গায়ের সার্ট খুলে ক্ষতস্থান বেঁধে নেয়। ওর সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন গাড়ি ও ওয়্যারলেস নিয়ে পালিয়ে যায়। সেলিম এক সময় সহযোদ্ধাদের নিয়ে নুরী মসজিদের ভেতরে আশ্রয় নেয়। সবাইকে কলেমা পড়ায় এবং শপথ করায়, ‘আমরা যুদ্ধ করে শহীদ হব, তবুও হানাদারদের হাতে ধরা দেব না।’ তার সহযোদ্ধারা বলেছিল, ‘স্যার, আপনি আমাদের ফেলে যাবেন না।’ সেলিম প্রতিজ্ঞা করে বলেছিল, ‘আমার গায়ে একবিন্দু রক্ত থাকতে তোমাদের ফেলে যাব না।’ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সেলিম এই সহযোদ্ধাদের ফেলে কাপুরুষের মত পালিয়ে আসেনি, যদিও ইচ্ছা করলেই সে পালাতে পারত। সেলিম ওয়াদা ভঙ্গ করেনি। ও ওয়াদা ভঙ্গ করতে জানত না। বীরের মত যুদ্ধ করে একচলিশজন সহযোদ্ধাসহ শহীদ হয়েছে মিরপুরে বধ্যভূমিতে।
দিনের শেষে কালাপানির ঢালে অবসন্ন শরীর রেখে রক্তস্নাত সেলিম বলেছিল তার ডান বুকে কালাপানির নোংড়া জল ঢুকলে সে বাঁচবেনা। সে পুলিশের লোদি ও নবিকে কালাপানির জলা পার হতে উৎসাহ যুগিয়েছে এবং রি ইনফোর্সমেন্টের জন্য অপেক্ষা করেছে। না তা হয়নি। আবারো ব্যাটেলিয়নের অক্ষমতার কারণে এবং পলায়নরত সৈনিকদের কাপুষতার কারণে।
মুক্ত হল মিরপুর। মিরপুর মুক্তিদাতা লে. সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান এ ভাবেই শেষ করলেন নিজের জীবন। বিকলের দিকে জীবিত সেনাদেরকে নিয়ে কালাপানির ঢালের কাছে সে দাড়িয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ফ্যাকাশে ও ক্লান্ত। সবাইকে উৎসাহ যুগিয়েছে, বিল পার হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যেতে। নিজে পানিতে নামেনি। বুকের ক্ষত পানিতে ডুবে যাবে এই কারণে। ক্লান্ত শরীরটা একটি গাছের আড়ালে রেখে একটা একটা করে গুলি চালছিল ঘাতকের দিকে। কভার ফায়ার দিয়ে সহযোদ্ধাদের সরে যেতে সাহায্য করছিল। হয়ত ভাবছিল জবরহভড়ৎপবসবহঃ আসবে। সেদিন রাতে মেঘে ঢাকা চাঁদ ছিল। ঝির ঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। হয়ত সেলিম আমার কথা, দেশের কথা, সহযোদ্ধাদের সাহায্যের কথা ভাবছিল। না কেউ তাকে উদ্ধার করতে যায়নি। সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে মেজর মইন ও কর্নেল শফিউলাহ। ওর প্রতীক্ষা কত দীর্ঘ হয়েছে জানিনা। এক সময় আকাশে ঐ ফ্যাকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমার চাঁদ বুঝি বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে। তখন ওর স্বপ্নে হয়ত ওর ভাই এবং অজস্র অশ্বারোহী।
ড. এম এ হাসান; চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ; প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড চিফ সায়েন্টিস্ট অ্যালার্জি অ্যাজমা অ্যান্ড এনভায়োরেন্টমেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ
মতামত দিন