বাংলাদেশে সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা খুব দ্রুত আবার বাড়ছে, যেটা ইংগিত দিচ্ছে একটা নতুন ঢেউ এর
করিম সাহেব জানেন যে করোনা ছড়ানো প্রতিরোধ করতে মাস্ক এর ব্যবহার খুবই প্রয়োজন। তবুও উনি মাস্ক নিয়মিত ব্যবহার করেন না। উনি কি নিজের অথবা উনার আশেপাশের মানুষের জীবন এর ব্যপারে উদাসীন? আমরা কি পারি উনাকে একটু সাহায্য করতে যাতে উনি নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করেন?
যেকোনো ধরনের আচরণগত পরিবর্তন আনা কঠিন কাজ, বিশেষত এটা যদি বড় পরিসর এ হয়। কোভিড-১৯ আমাদের জীবন যাপন পরিবর্তন ও নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু মানুষের অলসতা এবং পরিবর্তন বিমুখ প্রবণতার কারণে সামাজিক নিয়ম-কানুন মানতে কঠিন হচ্ছে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা খুব দ্রুত আবার বাড়ছে, যেটা ইংগিত দিচ্ছে একটা নতুন ঢেউ এর। এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রয়োজন সবাইকে মাস্ক পরতে উৎসাহিত করা যাতে করোনা আবারো নিয়ন্ত্রণ এর বাইরে চলে না যায়। বাংলাদেশের চিকিৎসা অবকাঠামোর দুর্বলতা আছে বলেই আমাদের এখনি সতর্ক হতে হবে।
এখন যখন আমরা সবাই একমত যে মাস্ক ব্যবহার খুবই প্রয়োজন, সরকারের নীতি নির্ধারক এবং প্রয়োগকারী সংস্থা গুলোর কাছে বিভিন্ন উপায় আছে মানুষকে নিয়ম মানতে উদ্বুদ্ধ করার। যারা মাস্ক ব্যবহার করছেন না তাদের জরিমানা করা এক ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ। আরেকটা উপায় হচ্ছে মানুষকে আরো শেখানো যে মাস্ক ব্যবহার কেন জরুরী। কিন্তু আমরা এও জানি যে শিক্ষা অথবা শাস্তি কোনটাই নিশ্চিত করতে পারেনা কাংখিত ব্যবহার এর পরিবর্তন। আমরা সবাই জানি স্বাস্থ্য সম্মত খাবার ও শরীরচর্চার উপকারিতা, বেশিরভাগ অংশ চাইও ওইসব পদক্ষেপ নিতে, কিন্তু দিনশেষে অনেকেই আর প্রয়োজনীয় কাজগুলি করতে পারিনা। এখানেই নাজিং (আলতো ধাক্কা), আচরণগত অর্থনিতি (বিহেভিওরাল ইকনমিক্স) এর একটি কৌশল আমাদের খুব কাজে আসতে পারে। নাজিং সাহায্য করে মানুষকে সঠিক সিধান্ত নিতে এবং আচরণগত পরিবর্তন আনতে।
চলুন দেখি মাস্ক ব্যবহার করতে কী কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয় মানুষকে। প্রথম ধাপ হচ্ছে মাস্ক ব্যবহার এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা। যদি আমরা মানুষকে মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন না করাতে পারি, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো খুব বেশি কার্যকর হবে না। সাধারণ মানুষ মাস্ক এর ব্যপারে সচেতন হয়ে গেলে তারপর মাস্ক কিনতে অথবা বানাতে হবে, মাস্ক সাথে নিতে হবে বের হওয়ার সময়, পরতে হবে নিয়মিত, এবং সর্বশেষে মাস্ক সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় নিষ্পত্তি করতে হবে। এই প্রতিটা ধাপ এ আমরা নাজিং কৌশল ব্যবহার করতে পারি মানুষকে সঠিক আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে।
চলুন দেখি কী কী নাজিং কৌশল আমরা ব্যবহার করতে পারি বিভিন্ন ধাপে-
সচেতনতা
সচেতনতা হচ্ছে প্রাথমিক ধাপ মাস্ক ব্যবহারকারির যাত্রায়। এই ধাপে, আমরা চাই মানুষকে সংবাদ দিতে যাতে সবাই বুঝতে পারে মাস্ক পরাটা কত জরুরি। বার্তা বিভিন্নভাবে তৈরি করা যায় যাতে মানুষের মধ্যে বাস্তবায়ন মানসিকতা জেগে ওঠে। মাস্ক ব্যবহারের উপকারিতা যদি আরো স্পষ্ট করা যায় তাহলে বার্তায় কাজ দ্রুত হবে। মাস্ক ব্যবহারের ফলে অন্যান্য স্বাস্থ্যগত উপকারিতা যেমন দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়াকে সবার দৃষ্টিগোচর করা যেতে পারে। মানুষের বাস্তবায়ন মানসিকতা জাগানো যেতে পারে আমাদের জাতীয় অর্জনগুলোকে উপস্থাপন করে। মার্চ মাষ আমাদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই সময়ে আমরা আমাদের জাতীয় অর্জনগুলিকে উপস্থাপন করে মানুষকে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে মাস্ক ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারি।
মাস্ক কেনা অথবা বানানো
মাস্ক কেনার খুব সহজ, দ্রত ও সাধারণ হতে হবে সবার জন্য। আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে হবে দুর্বল সম্প্রদায়গুলোর ব্যপারে। মাস্ক কেনার পদ্ধতিটি যত কম টাকা এবং সময় খরচে করা যাবে, ততই ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এইজন্য আমাদের মাস্ক কম খরচে এবং খুব সহজে কেনার ব্যবস্থা করে দিতে হবে সব জায়গায়। যদি মানুষ ঘরে বশে সহজে হাতের কাছের উপকরণ দিয়ে মাস্ক বানিয়ে নিতে পারে তাহলে অনেকের উপকার হবে। এইজন্য মানুষকে জানাতে হবে চাইলে কিভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুমোদিত মাস্ক সহজে ঘরে তৈরি করে নিতে পারবে খুব বেশী খরচ না করে। আমরা গরীব ও দুর্গম এলাকার মানুষদের বিনামূল্যে অথবা ভর্তুকি দিয়ে কম দামে মাস্ক সরবরাহ করতে পারি যাতে সবাই ব্যবহার করতে পারে।
বাহিরে যাওয়ার সময় মাস্ক সাথে নেয়া
এই ধাপে, মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে যাতে সবাই মাস্ক পরিধান করে। আমরা জানি যে মনে করিয়ে দিলে মানুষের মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। এইখেত্রে বার বার মনে করিয়ে দিতে পারলে মানুষ বাধ্য হবে বার বার মাস্ক পরার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে। মানুষ সাধারনভাবেই ভুলমনা এবং এইজন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে মাস্ক দরজার কাছে অথবা যেখানে চাবি ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ রাখে অইখানে রাখতে। তাহলে দ্রুত বের হয়ে যেতে গেলেও ভুলে যাবার সম্ভাবনা কমে যাবে। মাস্ক নিতে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য লিফট ও সিঁড়িতে স্টিকার অথবা নোটিস ঝুলিয়ে রাখলে ভুলে গেলেও কেউ দ্রুত সেটা আবার নিয়ে নিয়ে পারবে ঘর অথবা কাজের জায়গা থেকে বের হওয়ার সময়।
মাস্ক পরা
কিছু কিছু মানুষ মাস্ক সাথে থাকার পরেও পরতে চায়না। মানুষ যাতে সাথে থাকার পরও মাস্ক পরতে ভুলে না যায় অথবা অবহেলা না করে এইজন্য রাস্তায়, বাসে, গাড়িতে পোস্টার, ব্যনার এবং বিলবোর্ড এর মাধ্যমে মনে করিয়ে দিতে হবে। মানুষের আচরণগত একটা দিক হচ্ছে যদি আমরা দেখি যে বেশী মানুষ কোনকিছু মেনে চলছে, তাহলে আমাদেরও ওই নিয়ন মানার প্রবণতা বেড়ে যায়। এইজন্য মিডিয়াতে মানুষ নিয়ন মানছেনা এইটা নিয়ে যেমন সতর্কতামুলক সংবাদ প্রচার জরুরী তেমনি, যারা যারা মেনে চলছে তাদেরকেও আরো বেশী বেশী উপস্থাপন করা জরুরী। তাহলে অন্যের দেখাদেখি আরো বেশী মানুষের মাস্ক পরার প্রবণতা তৈরি হবে। এইভাবে একটা সামাজিক সম্প্রদায় তৈরি হবে যারা অন্যদের উৎসাহিত করতে পারবে।
ব্যবহৃত মাস্ক ফেলা অথবা পরিষ্কার করা
মাস্ক ব্যবহার শেষ ধাপ হচ্ছে ব্যবহৃত মাস্ক সহজে ফেলার ব্যবস্থা করা। যদি মাস্ক বারবার ব্যবহার উপযোগী হয়ে থাকে তাহলে পরিষ্কার করা সহজ ও সাশ্রয়ী হতে হবে। সবার কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে হবে কিভাবে এবং কোথায় সঠিকভাবে মাস্ক ফেলতে হবে অথবা পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাস্ক ফেলার জায়গা যাতে সবার হাতের কাছেই থাকে এইটা নিশ্চিত করতে হবে।
সবগুলি ধাপ বিবেচনা করে আসুন ধরে নেই যে আমাদের সবচেয়ে বড় বাঁধা হচ্ছে সচেতনতায়। এবং আমাদের মানুষকে অউধাবন করাতে হবে মাস্ক না পরার বিপদ সম্পর্কে। একের অধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষ সাধারণত যতনা লাভ পছন্দ করে তারচেয়ে বেশী ক্ষতি অপছন্দ করে। মানুষের আচরণগত পরীক্ষার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত। এই থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, বার্তা কিভাবে উপস্থাপন করা হবে তার উপর নির্ভর করে কার্যকারিতাও পরিবর্তন হতে পারে। মানুষের এই ব্যবহারকে বলা হয় ক্ষতি বিদ্বেষ (লস এভারশন)। এই আচরণগত বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করতে আমরা একটি ছোট বার্তা বিষয়ক টেস্ট করেছি যেখানে সবকিছু এক ছিল সুধুমাত্র একটি লাইন ছাড়া। দুইটি বার্তা তৈরি করা হয়েছিল বাংলা ভাষায় যাতে বাংলাদেশী মানুষ সবাই বুঝতে পারে সহযে। দুটি বার্তার একি ছিল একটি মেয়ের মাস্ক পরিহিত ছবি, একটি লাইন যেখানে বলা ছিল আট হাজারের বেশী মানুষ মৃত্যুবরণ করে করোনায় বাংলাদেশে, এবং একটি আহবান যেখানে বলা হয়েছে আসুন, সবাই মাস্ক ব্যবহার করি। দুইটি বার্তার মধ্যে পার্থক্য ছিল প্রধান লাইনে। একটি বার্তায় লিখা হয়েছিল “আর কাউকে হারাতে চাইনা আমরা”, যেখানে লক্ষ্য ছিল মানুষের ক্ষতি বিদ্বেষ (ছবি-১)। অপর বার্তায় লেখা ছিল “আমরাই পারি প্রতিটা জীবন বাঁচাতে” (ছবি-২), যেখানে লক্ষ্য ছিল মানুষের লাভের প্রতি আকর্ষণ। আমরা জানতে চেয়েছিলাম এই ছোট একটা পার্থক্য মানুষের মাস্ক ব্যবহার করার ইচ্ছা কতটুকু প্রভাবিত করতে পারে। আমাদের এই অনুমান পরিক্ষা করতে এই দুইটা বার্তা আমরা ২৫ জন করে সর্বমোট ৫০ জন কে দেখিয়েছি এবং জানতে চেয়েছি এটা দেখার পর উনারা কতটুকু ইচ্ছুক মাস্ক ব্যবহার করতে। সবাই ১ থেকে ৭ এর মধ্যে নাম্বার দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মাস্ক ব্যবহারের ইচ্ছার মাত্রা।
পরীক্ষার ফলাফল দেখায় যে যারা যারা এই বার্তাটি দেখেছেন “আর কাউকে হারাতে চাইনা আমরা” (ছবি-১) যেটাতে মানুষের খতির প্রতি বিদ্বেষকে লক্ষ্য করা হয়েছিল, তারা ১৫% বেশী মাস্ক ব্যবহার করতে ইচ্ছুক। নাম্বারটা যদিও খুব বেশিনা কিন্তু এটা প্রমাণ করতে পারছে যে আমরা কিভাবে কোন বার্তার কারযকারিতা বাড়াতে পারি সুধুমাত্র বার্তার উপস্থাপন পরিবর্তন করে যা বাঁচাতে পারে বহু জীবন। এই পরিক্ষাটি সম্পর্কে নিশিত হতে হলে আমাদের র্যানডোমাইযড কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি) চালাতে হবে এবং দেখতে হবে মানুষের আচরণ কতটুকু পরিবর্তন হয়। আমরা যদি বিভিন্ন নাজিং কৌশল গুলোর আরসিটি চালিয়ে দেখতে পারি তাহলে বুঝতে পারব কোনগুলি কার্যকর হবে এবং ওইগুলি জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করলে ফলফল সফলজনক হবে আশা করি।
নাজিং, নোবেল প্রাইজ বিজয়ী রিচার্ড থেলার দ্বারা উপস্থাপিত, একটি প্রমাণ ভিত্তিক কৌশল যা আচরণগত পরিবর্তন এ সহায়ক। আমরা, যারা মানুষ হওয়ার করণেই কিছুটা ত্রুটিযুক্ত, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিদ্বারা প্রভাবিত হই এবং অযৌক্তিক কাজ করি। আমাদের আচরণগত এই অযৌক্তিক ব্যবহারকে মেনে নিয়ে, আচরণগত অর্থনিতি আমাদের সাহায্য করতে পারে সামাজিকভাবে সঠিক দিকে অগ্রসর হতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও নীতি নির্ধারকরা আচরণগত অর্থনিতির বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করছেন সফলভাবে অ্যান্ড এর উপকারিতা পাচ্ছেন। এখনি সঠিক সময় বাংলাদেশেও আমরা এর ব্যবহার করে আরো প্রভাবশালী কার্যক্রম তৈরি করতে পারি এবং পারি আরো জীবন বাঁচাতে। অথবা এইক্ষেত্রে বলা উচিত, আর কোন জীবন না হারাতে।
নাসের আজাদ কানাডার টরেন্টোভিত্তিক একজন কমিউনিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ কনসালটেন্ট
মতামত দিন