‘গত ক’দিনে যেভাবে বুলেটের আঘাতে একের পর এক জীবন ঝরে পড়লো, তাতে মনে হতে পারে এদেশে এখন সবচেয়ে সস্তা বুঝি মানুষের প্রাণ। মনে রাখা চাই, যারা মারছে আর যারা মরছে - সবাই তো এ মাটিরই সন্তান’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। একটি জাতির জীবনে চরম আবেগময় একটি মুহুর্ত। বাঙালি জাতির জীবনে তো বটেই। কারণ, আজ থেকে ৫০ বছর আগে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে এ জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদারেরা অবশেষে গ্লানিময় পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হয়। তবে, এ জন্য এ জাতিকে দিতে হয়েছিল অনেক চড়া মূল্য, ঝরাতে হয়েছে এক সাগর রক্ত আর অসংখ্য মা-বোনকে হারাতে হয়েছে তাদের সম্ভ্রম। তারপরও ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিশতাধিক বছরের যে গোলামীর জিন্দেগী সূচিত হয়েছিল, তার অবসানে এ জাতি সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল।
রক্তে কেনা এ স্বাধীনতা তাই এ জাতির জীবনে সব সময়ই বিশেষ কিছু। সবচেয়ে বড় ও গৌরবময় অর্জন। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, বিশেষ করে জাতির ভবিষ্যৎ তরুণ-যুবাদের জন্য অনন্ত প্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যে এ জাতির জীবনে আবেগ ও আনন্দের মিশেলে এক অনন্য মুহুর্ত হিসেবে দেখা দিবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু আছে কী? এক বছর আগে এ দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর মহেন্দ্রক্ষণ জাতির এ আবেগ-উচ্ছাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। বিগত বছর ১৭ই মার্চ জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে শুরু করে বছরব্যাপী নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে মুজিব বর্ষ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। দুর্ভাগ্য, জাতি যখন বিপুল উদ্দীপনায় এ উদযাপন শুরুর দিকে এগুচ্ছিল, তখনই অলক্ষুণে করোনাভাইরাস অতিমারীর ভয়াল থাবা সব পরিকল্পনা লণ্ডভণ্ড করে দিল। তা সত্ত্বেও সীমিত পরিসরে বছরব্যাপী নানা আয়োজনে মুজিববর্ষ পালন অব্যাহত থাকবে। অবশেষে এ বছর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচির মাধ্যমে যার মেলবন্ধন ঘটে সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালার সাথে।
বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যখন সমাগত, দেশ করোনাভাইরাসের প্রাথমিক ধাক্কাটা ইতোমধ্যে সামলে নিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশকে টেক্কা দিয়ে বাংলাদেশ আগে ভাগে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া শুরু করতে সক্ষম হয়েছে। ভাইরাসের ছোবল আর বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়ের ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতি। এভাবে যখন করোনাভাইরাসের ঝুঁকিমুক্ত অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পরিবেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত বলে অনুমিত হচ্ছিল, আঘাত হানতে শুরু করল ভাইরাসটির নতুন ঢেউ। একদিকে তো এই নতুন আপদ, অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে সৃষ্ট তিক্ত বিতর্ক আনন্দের আমেজকে কেমন যেন বিষিয়ে তুলতে শুরু করে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে নজরকাড়া সব আয়োজনের মধ্যে অন্যতম ছিল বিশ্ব নেতাদের, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশসমূহের, সরকার/রাষ্ট্র প্রধানদের অংশগ্রহণ। এদের অনেকেই এ অনুষ্ঠানে সশরীরে অংশ নিয়ে এ আয়োজনকে মহিমান্বিত করেছে। অন্যরা তা না পারলেও বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন এবং এর উত্তরোত্তর আরও উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অতুলনীয় সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ বিবেচনায় এ অনুষ্ঠানে ভারতের অংশগ্রহণ বিশেষ গুরুত্ব পাবে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। স্বাধীনতার পর নানা বিষয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের মিঠেকড়া সম্পর্ক সত্ত্বেও ভারত আমাদের আজন্ম বন্ধু এবং নিকটতম প্রতিবেশী। স্বাভাবিকভাবেই তারা এ গুরুত্বের দাবিদার। এ নিয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ ছিল না। কিন্তু, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উগ্র সাম্প্রদায়িক, মুসলিম বিদ্বেষী ও নাগরিকপঞ্জির নামে আপাত: বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকার কারণে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মতো ঐতিহাসিক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র আপত্তি উঠে।
সরকারের জন্য বিষয়টি এক কঠিন সমস্যা তৈরি করে। একদিকে ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যার কিনা এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশাল ভূমিকা রয়েছে, তার প্রধানমন্ত্রী এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের দাওয়াত কবুল করেছেন এবং সাগ্রহে এতে যোগদানের অপেক্ষায় আছেন। অন্যদিকে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীর অতীত ও বর্তমান নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে বিভিন্ন সংগঠন যে কোন মূল্যে তার আগমন ঠেকাতে বদ্ধপরিকর বলে ঘোষণা দিতে থাকে। অবশেষে কিছু সংগঠন ২৬ মার্চ কোনো কর্মসূচি রাখবে না বলে ঘোষণা করায় বিষয়টির একরকম রফা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। তবে, অন্য কিছু সংগঠন তাদের অবস্থানে অবিচল থাকে।
বায়তুল মোকাররম থেকে একদল লোক মোদী-বিরোধী মিছিল বের করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং দৃশ্যত কিছু রাজনৈতিক কর্মীও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তাদের প্রতিহত করতে অবস্থান নেয়। এ সময় ওখানে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ফেসবুক-ইন্টারনেটের এ যুগে এ খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। কোনো কোনো জায়গায়, বিশেষ করে হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, প্রতিবাদী মিছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রূপ নেয়। ফলে, গত কয়েক দিনে অকালে ঝরে পড়ে অনেক তাজা প্রাণ। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে অনেক সহায়-সম্পদ। যে অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল এ দেশের মানুষের অনাবিল আনন্দের ফল্গুধারা, তা দেখল রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। উদ্বেগের বিষয় হলো, কোনো কোনো ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল লোকজন সরাসরি সংঘর্ষে অংশ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহে কার কতটুকু দায় ছিল সে বিতর্কে না গিয়েও বলা চলে, ইতিহাস চর্চায় আগামী দিনে এ দেশের মানুষ এ ক'টা দিন ভুলে থাকতে পারলেই বাঁচবে।
দেশটি স্বাধীন হয়েছিল রক্তের সাগর পেরিয়ে। একজন শান্তিপ্রিয় জননেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু '৭১-এর ২৫শে মার্চ পর্যন্ত রক্তক্ষয় এড়ানোর চেষ্টা করে গেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যখন তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখনও সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেন। আমি প্রায়ই ভাবি, তিনি কেন স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধীতাকারীদের অনেককেই উদারভাবে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। আমি একটি উত্তরই খুঁজে পেয়েছি: তিনি মনে করেছিলেন, এটি বিভেদের সময় নয়, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সময়। ৯০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু তনয়া যখন প্রথমবার সরকার গঠন করেন, তিনিও ঐকমত্যের সরকার গঠনের ডাক দিয়েছিলেন। আমার কাছে তার সেদিনকার আহ্বানকে বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথের অনুসৃতি বলেই মনে হয়েছে।
দেশ ও দশের স্বার্থে একজন জননন্দিত জাতীয় নেতার কর্মনীতি এমনটিই হওয়ার কথা নয় কী? ইতিহাস থেকে আমি দু'টি উদাহরণ দিব। মহানবী (সা.) যখন মক্কা বিজয় করেন, এত দিন যারা তাকে এত কষ্ট দিয়েছেন, তাকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন, তাদের সবাইকে তিনি উদারভাবে ক্ষমা করে দেন, কোনো প্রতিশোধ নেয়ার কথা চিন্তাই করেননি। তিনি চাইলে সেদিন মক্কায় রক্তের নহর বইয়ে দিতে পারতেন। মক্কাবাসীরা তাকে এবং তার সহচরদের যে অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন, তাতে এটাই কী তাদের প্রাপ্য ছিল না? কিন্তু, তিনি সে পথে হাঁটেননি। তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিলেন। অনাগত দিনের পৃথিবীবাসীর জন্যে এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এর ফল কী হয়েছিলো তা তো ইতিহাস। তার এ মহানুভবতায় এতদিনকার মরণপণ শত্রুদের মস্তক আপনিই নুয়ে এলো। এদের অনেকেই পরবর্তীতে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও দিগ্বিজয়ে অতুলনীয় ভূমিকা রাখলেন। দ্বিতীয় উদাহরণটি নিকট অতীতের। দীর্ঘ সংগ্রামের পর দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জননেতা নেলসন ম্যান্ডেলা যখন বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হন, তার এতদিনকার শত্রু শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের সাথে শত্রুতা ভুলে গিয়ে সবাইকে নিয়ে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে হাত দেন। তা না করলে আজও দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের চিরায়ত সংঘাত অব্যাহত গতিতে বহমান থাকত।
যে প্রশ্নটি আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, দেশ কী এভাবে অনৈক্য, হানাহানি আর বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ঘুর পাক খেতে থাকবে? হিংসা হিংসার জন্ম দেয়। রক্তপাত আরও রক্তপাতের পটভূমি তৈরি করে। দেশের প্রধাণ দু' দলের দুই প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান উভয়েই ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন। কাজেই, প্রিয়জন হারানোর বেদনা অন্য কেউর চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কম বুঝেন এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু, গত ক’দিনে যেভাবে বুলেটের আঘাতে একের পর এক জীবন ঝরে পড়লো, তাতে মনে হতে পারে এদেশে এখন সবচেয়ে সস্তা বুঝি মানুষের প্রাণ। মনে রাখা চাই, যারা মারছে আর যারা মরছে - সবাই তো এ মাটিরই সন্তান। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, এত রক্তক্ষয়ের পরেও কিছু স্বার্থান্বেষী মহল হিংসা-বিদ্বেষ আরও উসকে দিতে চায়। দেশকে নামে-বেনামে ক্রমাগত বিভক্ত করে এরা কার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে কাজ করে যাচ্ছে তা চিন্তা করার এখনই সময়। দেশি-বিদেশি যে সব মতলববাজ দেশটাকে লুটেপুটে খেতে চায়, তারা কখনই চাইবে না এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোক। এখন, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কী তাদের ফাঁদে পা দিয়ে দেশকে সর্বস্বান্ত করব, নাকি নিজেদের মধ্যকার বিভেদ কমিয়ে এনে দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেব। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে জাতির জীবনে এমন অমানিশা নেমে আসতে পারে, যেখান থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
সবাই ভাল থাকুন।
ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন, অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না
মতামত দিন