দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে- এটা শুধু কাগজে কলমে থাকলে চলবে। একইসঙ্গে আইন সকলের জন্য সমান হবে। কোনো রকম প্রভাব বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই অপরাধীদের বিচার করতে হবে
গত ১৫ নভেম্বর ২০২০-এ প্রকাশিত “দৈনিক প্রথম আলো” সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ রেল বাজারে ১০ টাকা দামের মিনি সাবান কিনেছে ২৫ টাকায়, ১৩০ টাকা মূল্যের ২৫০ মিলিলিটার জীবানুনাশক কিনেছে ৩৮৪ টাকায়, রাজধানীর লাজফার্মায় গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে রাবারের ১০০টি গ্লাভসের একটি বাক্স ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে একেকটি গ্লাভসের দাম ছিল ৮ টাকা। রেল এই ধরনের একেকটি গ্লাভস কিনেছে ৩২ টাকায়। করোনাকালের শুরুতে তারা গ্লাভস, মাস্ক, থার্মোমিটার, জীবানুনাশক টানেল ও সাবানসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী কিনেছে এবং এ ক্ষেত্রে ব্যয় করেছে ৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, সব পণ্যই বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয়েছে এবং ওই সময় রেল উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করেনি। রেলের অনেক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, “করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে কেনাকাটার নামে রেলের টাকা ভাগাভাগি করা হয়েছে।”
এটা দুর্নীতি। এ রকম অর্জন দুর্নীতির খবর প্রায় দিনই প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের “গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার এশিয়া ২০২০” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের শতকরা ৭২% মানুষ মনে করেন, সরকারি দুর্নীতি সবচেয়ে “বড় সমস্যা”।
বাংলাদেশে দুর্নীতির ধরনগুলো কেমন জানতে চাইলে “ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)”-এর গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক রফিক হাসান বলেন, “সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, ভূমি, ব্যাংকিং, পাসপোর্ট, আইন শৃঙ্খলা এবং বিচারিক ইত্যাদি সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দেন বা দুর্নীতির শিকার হন। এছাড়াও এখানে সরকারি সম্পত্তি দখল, অর্থ আত্মসাৎ, হুন্ডি, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে মূল্য কম টাকা দেখিয়ে সেই টাকা বিদেশে রেখে বা আন্ডার ইনভয়েস এবং ওভার ইনভয়েস করার প্রচলন এখানে অনেক বেশি। ইদানিং অর্থপাচারকে বাংলাদেশের অনেক বড় দুর্নীতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।”
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ লিখিত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, “প্রচলিত সব ধরনের দুর্নীতি দুদকের তফসিলভুক্ত নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এ সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগকে দুর্নীতি বলা হচ্ছে। এই আইনের সংযুক্ত তফসিলে দ-বিধির কতিপয় ধারা ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর কতিপয় ধারাকে দুর্নীতিমূলক কাজ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তবে মোটাদাগে এ জাতীয় অপরাধগুলো হচ্ছে এমন- সরকারি কর্তব্য পালনের সময় সরকারি কর্মচারি/ব্যাংকার/সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক উৎকোচ (ঘুষ)/উপঢৌলকন গ্রহণ, সরকারি কর্মচারি/সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো ব্যক্তির অবৈধভাবে নিজ নামে/বেনামে সম্পদ অর্জন, সরকারি অর্থ/সম্পত্তি আত্মসাৎ বা ক্ষতিসাধন, সরকারি কর্মচারি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যবসা/বাণিজ্য পরিচালনা, সরকারি কর্মচারি কর্তৃক জ্ঞাতসারে কোনো অপরাধীকে শাস্তি থেকে রক্ষার প্রচেষ্টা, কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনকল্পে সরকারি কর্মচারি কর্তৃক আইন অমান্যকরণ, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর অধীন সংঘটিত অপরাধসমূহ এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি/ব্যাংকার কতৃক জাল-জালিয়াতি এবং প্রতারণা ইত্যাদি।”
সরকার বা দুদক দুর্নীতি দমনে কীভাবে কাজ করছে জানতে চাইলে ইকবাল মাহমুদ বলেন, “কমিশন একটি সুনির্দিষ্ট আইনি পরিকাঠামোর মধ্য থেকে দুর্নীতি দমনে কাজ করছে। অভিযোগ গঠন থেকে শুরু করে মামলা দায়ের পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে কমিশন সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করছে। অভিযোগ প্রমাণে যে সব দালিলিক প্রমাণাদির প্রয়োজন সেগুলো যেমন নিখুঁতভাবে সংগ্রহ করা হয়, তেমনি প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য-প্রমাণও সংগ্রহ করা হয়। আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণসহ সকল প্রকার আলামত উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞ আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য পর্যালোচনা করে আদেশ প্রদান করেন। একটি স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে দুর্নীতি দমনে কাজ করছে কমিশন।”
দুর্নীতি দমন করতে হলে এর কারণগুলো জানা জরুরি। নইলে এর মূলোৎপাটন সম্ভব নয়- এমনই জানান রফিক হাসান। তিনি আবারও বলেন, “এর অনেক কারণ রয়েছে। তবে মোটা দাগে কয়েকটি কারণের কথা বলা যায়। যেমন ১. এখানে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা নেই। যদিও কখনো তা ছিল, সেগুলোকেও অকার্যকর করে দেয়া হয়। তাই কোনো প্রতিষ্ঠানে এটা কার্যকর নয় এবং কোনো দুর্নীতি হলে সঠিক ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তাই দুর্নীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। দুদক বড় দুর্নীতি নিয়ে কাজ করতে পারে না। পুলিশ, র্যাব বা সাংবাদিকরা যে বিষয়গুলো বের করে আনে সেগুলো নিয়ে দুদক কাজ করে। ২. আইনের বাস্তবায়ন নেই বলে মানুষ দুর্নীতি করার সুযোগ পায়। ৩. এখানে জনগণ তার আয়ের হিসাব বা করের তথ্য ঠিকভাবে দেয় না এবং এটা আদায়ে তেমন জোরদার ব্যবস্থা নেই ইত্যাদি। তবে দেখা গেছে, ইদানিং ছাত্র বৃত্তি এবং অন্যান্য ভাতাগুলো ডিজিটাল মাধ্যমে সরাসরি প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বলে এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। এখন ভূমির পর্চা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে নিতে হয় না। ইউনিয়ন পর্যায়ের কাউন্সিল থেকে অনলাইনের মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহ করা যায়। অর্থাৎ যে বিষয়গুলো ডিজিটাল মাধ্যমে পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রগুলোতে দুর্নীতির পরিমাণ অনেকটা কমে গেছে।”
আরও দুর্নীতি কমানো প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব- জানতে চাইলে “টিআইবি”র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গবেষণা ও অন্যান্য কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি চারটি উপায়ে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব। এটা শুধু আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, এটা পৃথিবীর যে কোনো দেশের জন্য প্রযোজ্য। ১. রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে- এটা শুধু কাগজে কলমে থাকলে চলবে না এটা বাস্তবে থাকা প্রয়োজন। কারো প্রতি কোনো রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন না করে এটা থাকতে হবে। দেশের শীর্য পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে নিন্ম পর্যায় পর্যন্ত এর প্রয়োগ থাকতে হবে। ২. আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে- এক্ষেত্রে যারা বিচারের আওতায় আসবে তাদেরকে আইন অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আইন সকলের জন্য সমান হবে। কোনো রকম প্রভাব বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই অপরাধীদের বিচার করতে হবে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য থাকতে হবে- দুর্নীতি দমনে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান কাজ করছে সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা থাকতে হবে। যেমন জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন এবং দুদক যাদের উপর দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব রয়েছে, তাদেরকে সকল প্রকার প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে কাজ করতে হবে এবং সক্রিয় থাকতে হবে। তারা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে থাকবে এবং কেউ তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। জাতীয় সংসদের যে কমিটিগুলো রয়েছে সেগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে সক্রিয় থাকবে এবং তাদের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। ৪. সাধারণ মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে- শুধু আইন প্রয়োগ করে বিচার করলে হবে না দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং এর প্রতিবাদ করতে হবে। তাদেরকে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে। দুর্নীতির যে কোনো তথ্য বা খবর প্রকাশ করার জন্য সোচ্চার এবং আন্তরিক হতে হবে। এগুলো মানলে দুর্নীতি দমন বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। আমাদের দেশে এগুলোর সবকিছু আছে। কিন্তু তা কাগজে-কলমে, বাস্তবে নেই।”
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হলে আমাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ জোরদার করতে হবে। এ জন্য যে ধরনের পদক্ষেপের কথা বিশেষজ্ঞরা বলছেন তা গ্রহণ করার এখনই সময়, বলছেন সুশীল সমাজ। ডিজিটালাইজেশন করার মাধ্যমে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর করার যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তা আরো ব্যাপকভাবে চালু করলে সফলতা পাওয়া যাবে- এমনই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টজনদের।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না
মতামত দিন