“রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে। প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা রয়ে যাবে অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়।” - ওমর খৈয়াম। আমি বই পড়তে পছন্দ করি। বন্ধুরা বলে, বইয়ের সাথে নির্বাসনে দিলে আমি নাকি দিব্যি আনন্দে সময় কাটিয়ে দিতে পারবো। কথা সম্ভবত খুবই সত্যি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শহর থেকে গ্রামে আসার সময় সবেমাত্র দুটি বই নিয়ে এসেছি। সিনেমা যা নিয়ে এসেছিলাম তাও শেষ প্রথম কয়েকদিনেই। তাই পুনরায় দেখা শুরু করলাম। বুঝতেই পারিনি এতোদিনের জন্য গ্রামের (কালীগঞ্জ, গাজীপুর) বাড়িতে আটকে যাবো। এখানের পরিস্থিতি ততোটা ভালো না। এখনো পর্যন্ত (২০ এপ্রিল) আমাদের উপজেলায় ৪৪ জনের করোনা পজিটিভ হয়েছে। তার মধ্যে শুধুমাত্র গত ২৪ ঘন্টায় ৩১ জন শনাক্ত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে কয়েকজন সংক্রমিত হওয়ার পর এখানের চলাফেরায় অনেক কড়াকড়ি করা হয়েছে। সময় কিভাবে কাটাবো সে এক মহা আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। প্রায় বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। অবশেষে চিন্তা করলাম, এই খারাপ সময়গুলোকে ভালো সময়ে রূপান্তরিত করার অন্তত একটা প্রচেষ্টা তো করতে পারি। হঠাৎ করেই নতুন কিছু একটা করার ঝোঁক তৈরি হল। তারপরেই দৃষ্টি পড়ল কৃষি কাজের দিকে।
এই সংকট আমাদের নিত্যদিনের গতানুগতিক জীবন যাপনের পদ্ধতিকে ভেঙে দিয়েছে। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে আমাদের যাবতীয় ব্যবস্থার প্রতি। বলে রাখা ভাল, আমাদের পরিবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা করছে, যদিও গ্রামে তা বেশ কঠিন। তবুও নিজেদের সীমানা আর পরিসরের মধ্যে থেকেই যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি আমরা।
এখানের সকালটা শুরু হয় ভিন্নরকম সৌন্দর্য দিয়ে। দোয়েলের শিস, কবুতরের ডাক, মোরগের ডাকসহ বিচিত্র পাখির কোলাহলে মুখরিত গ্রামের সকাল। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে প্রার্থনা করি। তারপর অল্প সময় মেডিটেশন। মনের চর্চার পর কিছুটা শরীরচর্চাও করি বটে। কারণ এই সময়ে মন এবং শরীর দুটো সুস্থ রাখাই গুরুত্বপূর্ণ। একাডেমিক পড়াশোনায় হাত দেওয়ার পূর্বে কখনো চা-বিস্কুট থাকে কখনো শুধুমাত্র বিস্কুট-ই থাকে। পড়াশোনা শেষে ঘড়ির কাঁটা যখন সকাল নটা ছুঁই ছুঁই তখন আমাদের নাস্তার সময়।
নাস্তার পরই মূলত শুরু হয় কৃষি সংক্রান্ত কার্যক্রম। এখন দিনের একটা বড় অংশ কৃষি কাজে ব্যয় হচ্ছে। বিভিন্ন গাছের যত্ন নেওয়া, আগাছা নিধন, ভূমি প্রস্তুত, বীজ রোপণ, মাচা মেরামত, গাছের ডালপালা কর্তন এই সবই আপাতত আমাদের কৃষি কাজের গুরুত্বের প্রধান সারণীতে। উল্লেখ্য যদিও আমি গ্রামে জন্মেছি তবুও এই ব্যাপারে আমার একেবারেই জানাশোনা ছিলো না। কারণ যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এই ভয়ে শৈশবে মা-বাবা দূরে রেখেছিল। তাই নতুন করে অনেক কিছু জানতে হচ্ছে, শিখতে হচ্ছে।
এখন লেবু গাছ, আমগাছ, জাম্বুরা গাছ, জামগাছ, কাঁঠাল গাছ এবং পেয়ারা গাছের যত্ন দিচ্ছি। কোনোটাতে শুধুমাত্র গাছের গোড়ায় মাটি দিলেই হয়ে যাচ্ছে। আবার কোনোটাতে আগাছা পরিষ্কার করে, মাটি আলগা করে গোবর (জৈব সার) মিশিয়ে দিতে হয়েছে। আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, ইতোমধ্যে লেবু, জাম্বুরা, আম, কাঁঠাল হয়েছে এবং বেড়ে উঠছে। পেয়ারা এবং জামগাছে ফুল হয়েছে। অন্যদিকে আমড়া গাছে ফুল হয়েছে, নারিকেল আছে গাছে, বেল প্রায় পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে এই বেল গাছে তিন কিংবা চারটির বেশি বেল কখনোই দেখা যায়নি। যেহেতু বাজার বন্ধ তাই আর নতুন করে কোনো গাছ লাগানো যাচ্ছে না। শুধুমাত্র একটি পেঁপে চারা এবং কয়েকটি সজনে ঢাল রোপণ করা হয়েছে। অবশ্য ২ দিন পূর্বে বেশ কয়েকটি কলা চারা রোপণ করা হয়েছে। এই সময়ে ত্রাণ চুরির ঘটনা দেখে উপলব্ধি করলাম, আঙুল ফুলে কিভাবে কলাগাছ হয়! যাই হোক সাগর, সবরি, চাম্পা, গেরা এই চার জাতের কলাগাছ রোপণ করা হয়েছে। মনে পড়ছে বিখ্যাত গ্রামীণ প্রবাদ, “কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।”
আমরা শাক-সবজি বাগানের পরিসর বৃদ্ধি করেছি। লাল শাক পরিণত হয়েছে৷ বেগুন হচ্ছে এবং ঢেঁড়শ চারা বড় হচ্ছে। চাল কুমড়া এবং করলা চারা রোপণ করা হয়েছে। শসা, বাঙ্গি এবং মেস্তা পাতা (চুকুর) চারা এখনো বীজতলায়, মাটি প্রস্তুত করা হচ্ছে। ধুন্দুল চারা সংগ্রহ করেছি। চিচিঙ্গা বীজ খুঁজছি কিন্তু এখনো পাইনি। পেস্তা রোপণ করা হয়েছে। কাকরোল চারা পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিসরে রোপণ করা হয়েছে। একটি মাচা প্রস্তুত করা হয়েছে। আরও সম্ভবত দুটি মাচা প্রস্তুত করতে হবে। বৃষ্টি পেয়ে ধনিয়া পাতা আরও সুন্দর হয়েছে। অতি সম্প্রতি আগাছা এবং বিচ্ছিন্ন জায়গা থেকে ১২টি টমেটো চারা উদ্ধার করেছি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, অল্প কয়েকদিনের যত্নে এখন চারা প্রায় ফলবান হয়ে উঠেছে।
বাড়ির আশেপাশের আগাছা-ময়লা পরিষ্কার করে, দু-এক জায়গায় মাটি তুলেছি। জীবনে এই প্রথম এতোটা সময় ধরে মাটি কাটা এবং মাটি নেওয়ার অভিজ্ঞতা। কিছুটা কষ্টকর এবং আনন্দময় এই অভিজ্ঞতা। মাটি যেন অপসারিত না হয় সে জন্য দূর্বাঘাসও রোপণ করতে হয়েছে। বৈশাখ মাস বলে ঝড়ের প্রবল সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে, সেক্ষেত্র চারা গাছের জন্য ঠিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে পুকুর পাড়ের সব আগাছা পরিষ্কার করেছি। মাছের জন্য খাবার কেনা হয়েছে। এমনকি মাছ লাউ পাতা খেতেও পছন্দ করে। প্রশ্ন করতে পারেন কিভাবে জানলাম? তিনদিন পূর্বে লাউ গাছ মাচা থেকে পুরোপুরি অপসারণ করা হয়েছে তারই কিছুটা অংশ পুকুরে পড়েছিল। দেখলাম লাউ গাছের পাতা একটিও নেই শুধুমাত্র ডাটা আছে! প্রায় বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করছি। অধিকাংশ সময় সরপুঁটি মাছ ধরে, তবে কখনো কখনো তেলাপিয়া, কার্প, শিং এবং অল্পবিস্তর রুই মাছের দেখাও মিলে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পুকুরের পাড়গুলো মেরামত করবো এবং কিছুটা গুছিয়ে মাছ চাষ করবো।
সম্প্রতি ঘুঘুপাখি ঘরের পাশে বাসা বেঁধেছে। ঘুঘুপাখি একটানা ডাকে। কি যে মায়াবী সুর। মন কোথায় যেন হারিয়ে যায়! বক এবং মাছরাঙা পাখি পুকুরে প্রতিদিন মাছ শিকারের জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকে। ফিঙে পাখির নৃত্য কি অসাধারণ! পুকুরের পাশে ডুমুর গাছ, সেখানে বুলবুলি পাখির চারটি বাচ্চা হয়েছে। মা পাখিটা সারাদিন বাচ্চাদের খাবার সন্ধানরত। শালিক, চড়ুই, দোয়েল, টিয়া, হলদে পাখি, কাঠঠোকরা, বক, মাছরাঙা, কোকিল, টুনটুনি, বাবুই, খয়েরি হাঁড়িচাচাসহ নাম না জানা কতো পাখির কোলাহলে মুখরিত আমাদের আঙ্গিনা। গন্ধরাজ গাছে ফুল ফুটেছে। কি মিষ্টি গন্ধ! প্রজাপতির ছড়াছড়ি। অন্যদিকে ফসলের মাঠে অনেক ফড়িংয়ের দেখা মেলে। নানারকম ঘাস ফুলেদের সাথে নিয়মিত পরিচিত হচ্ছি। নাম না জানা কতো রঙিন ফুলের ঠিকানা এই আগাছা।
বিকেলে ঘন্টাখানেক নিদ্রাযাপন করি। তারপর কিছুটা সময় পুরাতন সিনেমাগুলোই দেখি। সম্প্রতি পছন্দের তালিকায় যোগ হয়েছে কয়েক ক্যাটাগরির সিনেমা। যেমন: সত্য কাহিনী অবলম্বনে, উৎসাহমূলক এবং রহস্যময়। ঘুম থেকে জেগেই ধানক্ষেত পরিভ্রমণ করি। অবারিত সবুজ, মুক্ত আকাশ এবং মুক্ত বাতাস। বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। এসব করে ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। দুপুরে যদিও তীব্র রোদ কিন্তু সন্ধ্যার নিকটবর্তী সময়ে তাপমাত্রা কমতে থাকে। সম্ভবত গ্রামে এখনো কিছু গাছ আছে বলেই রক্ষা।
সন্ধ্যায় হালকা নাস্তার পর অনলাইনে ইংরেজি শিখতে বসি। আপাতত এক মাসের একটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। সেখানে ৩০ দিনে ৩০টি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লিখতে হবে। ইতোমধ্যে ১২ দিন সম্পন্ন করেছি। উল্লেখ্য আমার ভাষা শিক্ষা সহযোগী লস এঞ্জেলস থেকে উনি খুবই সহযোগিতাপরায়ণ এবং আন্তরিক। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হলে, রাতের খাবার খেতে যাই।
রাতের খাবারের পর প্রায় লিখতে বসি। আজকাল ঝড়ের কারণে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ থাকছে না। প্রথম দিকে মোমের ব্যবহার শুরু করেছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত পুরাতন হারিকেন উদ্ধার করলাম। প্রয়োজন হলে কখনো কখনো হারিকেনও ব্যবহার করছি। হারিকেনের আলো সে এক ভিন্নরকম সৌন্দর্য। যদি কখনো লিখতে গেলে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায় তবে লেখা থামাচ্ছি না! অন্ধকারেই লিখছি। যদিও লেখা কিছুটা আঁকাবাঁকা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ্য।
সারাদিনই অল্প বিস্তর আড্ডা চলে পরিবারের সাথে। রাতে আলোচনার পরিমাণ আরও বাড়ে। আলোচনার নানা রকম বিষয় থাকে। যেমন: রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, ধর্মীয় বিষয়, করোনাভাইরাস, আমাদের দায়িত্ব, কখনো আলোচনার বিষয় আমাদের সীমানাও ছাড়িয়ে যায় বটে। ছোটবোন কাজিনের নিকট থেকে বেশ কয়েকটি বই সংগ্রহ করেছে। তার দিনের বড় অংশ কেটে যায় এইসব বই পড়েই। ইউটিউবে ভিডিও দেখে নিত্যনতুন রেসিপি তৈরি করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি সেলাই মেশিনে কাপড় বানানো শিখছে। মা যদিও প্রায় সারাদিনই রান্না-বান্না সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত। তবুও কাথা মেরামতে কিছুটা সময় ব্যয় করছে। মাঝেমধ্যে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এবং পাওয়ার পয়েন্টও শেখার চেষ্টা করছে। বাবা আর আমি প্রায় সারাদিনই কৃষি কাজে ব্যস্ত। বাবা দুই একদিন পরপর শুধুমাত্র প্রয়োজনে বাজারে যাচ্ছে। বাজারে দোকান খোলা থাকে সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত। পরিবারের সবাই নামাজগুলো ঘরেই আদায় করছে। নিয়ম করে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করছে।
পরিচিতি, ঘনিষ্টজনসহ যারা এখনো শহরে স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে তাদের সাথে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ রাখছি। যোগাযোগ রাখছি আত্নীয়-স্বজন, পরিচিত লোকজনের সাথেও। এমনকি পরিচিতদের মধ্যে যারা চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত তাদের সাথেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি। অনলাইনে অল্প বিস্তর স্বেচ্ছাসেবী কাজও করছি বটে। তবে তা খুবই সামান্য।
হঠাৎ করেই বিভিন্ন রকম কৃষি কাজে অনেক বেশি জড়িত হওয়ার ফলে সর্দির একটা প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাড়িতে কয়েকটি তুলশী গাছ আছে বলে, সেক্ষেত্রে আর কোনো ঔষধের প্রয়োজনও পড়ছে না। সারাদিন মাঝেমধ্যে অনলাইন পত্রিকা দেখে দেশের খোঁজ-খবর রাখছি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকাগুলোতে প্রায় ঢুঁ মারছি। আমাদের একটা পোষা বিড়াল আছে। তার নাম বিল্টু। বিল্টুর সাথেও কিছুটা সময় কাটাচ্ছি। এছাড়াও মা-বাবা, ছোটবোন এবং প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করা তো হচ্ছেই।
এতোকিছুর পরেও ছোটবোন প্রায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। খুব সহজেই রেগে যাচ্ছে। বাবার মেজাজও প্রায় বিগড়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো আমার সাথেও জটিলতা হচ্ছে। এমনকি মা ও মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত দীর্ঘদিন ঘরে আটকে থাকার ফলেই এই অবস্থা। এইসব দেখে কখনো কখনো আমার মেজাজও বিগড়ে যাচ্ছে। তবুও আমাকে আরও বেশি ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে হচ্ছে।
সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে রাত দশটার মধ্যেই ঘুমের অতল সাগরে হারিয়ে যাই। গভীর রাতে প্রায় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। অবশ্য নীরবতার জন্য গভীর রাত উত্তম সময়। নীরবতা, নিস্তব্ধতা আমার অসম্ভব পছন্দ। যদিও নীরবতা আর নিস্তব্ধতা মানে শব্দহীনতা নয় বরং বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক শব্দের সমাহার বলেই মনে হয়। গভীর রাতে শীতল পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। হাজারও জোনাকির সমাহার হয়। যেন আলোর মেলা বসেছে। প্রায় রাতে অজস্র তারাদেরও মেলা বসে। কখনো কখনো তারা গণনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি তবুও সংখ্যা শেষ হয় না। এই একাকী সময়গুলো নিজেকে উপলব্ধি করা এবং নিজেকে গভীরভাবে জানার সুযোগ তৈরি করে দেয়। সুবিশাল, বিস্তীর্ণ পৃথিবীতে আমাদের প্রজ্ঞা, জ্ঞান কতোটা সীমিত। খুব মনে পড়ছিলো, কার্ল সাগানের সেই বিখ্যাত লেখাটাঃ "Pale Blue Dot: A Vision of the Human Future in Space"। কতোই না ক্ষুদ্র আমরা! কতোই না ক্ষুদ্র আমাদের পৃথিবী!
এখানের প্রায় প্রতিটি দিন আলাদা। প্রথাগত পদ্ধতি এখানে প্রায় অকার্যকর বলা চলে। কৃষির সাথে জীবনের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক মাঠে থাকলে আরও গভীরভাবে আবিষ্কার করা যায়। আহমদ ছফার “পুস্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ” বইয়ের প্রতিটি লাইন এখন আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। ফসল উৎপাদন কি যে সীমাহীন পরিশ্রমের কাজ, সম্ভবত তা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা মুশকিল! একটা ধান কিংবা একটা লাউ পরিণত হওয়া পর্যন্ত কতগুলো ধাপ যে সম্পন্ন করতে হয় তা যদি কেউ জানতো, তাহলে সম্ভবত কোনোদিন কেউ খাদ্যের অপচয় করতো না। আর যে মূল্য আমরা কৃষককে দিই তা সম্ভবত কখনোই যথেষ্ট নয়। শ্রদ্ধা সকল কৃষক ভাইদের প্রতি, যাদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাদের সভ্যতা টিকে আছে।
আমাদের গ্রামে (সাইলদিয়া) যুবকদের বেশ কিছু উদ্যোগ আশা জাগানিয়া। গ্রামের বাহির থেকে সকল ধরনের সাধারণ পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। গ্রামের প্রবেশপথে দুজন পাহারাদার রাখা হয়েছে। যারা বাজার থেকে ফিরে কিংবা গ্রামে প্রবেশ করে তাদের প্রত্যেকের হাত সাবান দিয়ে ধৌত করে তারপর প্রবেশ করতে হয়। যদিও সামাজিক দূরত্ব ব্যাপারটা ততোটা মানা হচ্ছে না। তবে গ্রামের যে দুটি দোকান রয়েছে তা খোলা এবং বন্ধের সময় নির্ধারণ করা আছে।
সময়টা বেশ সংকটের। আগামী দিনে সংকট হয়তো গভীর থেকে আরও গভীরতর হবে। এখন নিজেদের সাথে বোঝাপড়া করার সময়। ধীরে-স্থীরে, ভেবেচিন্তে পথ চলাই উত্তম। তবে আশার কথা হল, রাত যত গভীর হয় প্রভাত ততোটাই নিকটবর্তী। কিন্তু নিরাশার বিষয় হল, এমনকি কখনো কখনো এটাও সত্যি কোনো কোনো প্রভাত রাতের তীব্র অন্ধকারের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে৷ ঝড়, তুফান, অন্ধকার রাত্রি, সংকট, ভয়, ব্যাথা, ভোগান্তি, ক্লান্তি, অবসাদ, বিরক্তি, একাকীত্ব এই সবই আমাদের জীবনের অংশ। কখনো কখনো আমারও খুবই ক্লান্তি লাগে। তখন মনে পড়ে, রুমীর বিখ্যাত পংক্তি, "I know you are tried, but come. This is the way" (আমি জানি তুমি ক্লান্ত তবুও আসো, কারণ এটাই জীবনের পথ)।
শুধু মন খারাপ হয় এই ভেবে প্রতিদিন ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি বাড়ছে। মানুষ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ছে। সমগ্র পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে এক ভয়াবহ সংকটের দিকে। একদিকে ক্ষুধা, নিগ্রহ, নির্যাতন, নিপীড়ন, যুদ্ধ, সংঘাত, লোভ, হিংসা, ক্ষমতার উদগ্র বাসনা, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, পুঁজিবাজ, অবাধ ভোগবিলাস অন্যদিকে মহামারি। সমগ্র পৃথিবীতে মানুষের জন্য আর একখণ্ড নিরাপদ ভূমির অস্তিত্ব নেই! একথা আজ সর্বজনবিদিত, নিজেদের সীমানার মতো মধ্যে কেউ একা ভালো থাকতে পারে না। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তিগুলো আজ অসহায়। মানবজাতি নিজেদের মধ্যে সীমানা আর শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে হানাহানি, বিভেদ বাড়িয়ে এই পৃথিবীর অস্তিত্বকে কি আরও সংকটের মধ্যে ফেলবে? নাকি এক দেশ আরেক দেশের পাশে, এক মানুষ আরেক মানুষের পাশে দাঁড়াবে। সম্ভবত এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়ে গেছে!
তবে এই কঠিন সময়ে মৃত্যুর আশংকা জেনেও অনেক স্বেচ্ছাসেবী, চিকিৎসক, প্রশাসক, আইন-শৃংখলা বাহিনী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অন্য মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এইটুকুই হচ্ছে আশার কথা আর এইটুকুই মানবজাতির শক্তি। আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও মানুষকে সহযোগিতা করতে পারি, মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি লাইন টেনেই শেষ করছি। “মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও, এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও, মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।”
যাই হোক, যখন সমাজে ভয়, অভাব আর ক্ষুধার রাজত্ব বাড়ে তখন গুজব, কুসংস্কার এবং অযৌক্তিক চিন্তার বিকাশ ঘটে। এই সময়টায় মানুষ কাল্পনিক মিথ্যা এবং গুজবের উপর ভর করে সত্য এবং বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে চায়। তাই আমি সতর্ক আছি, নিজের দুর্বলতাবশতঃ যেন অযাচিত কোনো চিন্তার বিকাশ না ঘটে। অন্যদেরও সতর্ক করতে পারলে ভালো। এই সময়ে গণমাধ্যম এবং যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন তাদের দায়িত্ব একটু বেশি। করোনায় কতোজন আক্রান্ত, কতোজনের মৃত্যু হয়েছে, কোন কোন জেলায় সংক্রমিত হয়েছে শুধুমাত্র এই জাতীয় সংবাদ গণমানুষের মধ্যে আতংক তৈরি করতে পারে। তাই কতোজন সুস্থ হয়েছে, সারাবিশ্বে সুস্থতার পরিমাণ কতোটা বেশি, গড় মৃত্যুহার কতোটা অল্প সেটাও গুরুত্বের সাথে প্রচারের দাবি রাখে। কোন দেশ করোনাকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে এবং কি কারণে এইসব সংবাদ এবং বিশ্লেষণ সমাজে নতুন আশা তৈরি করতে পারে। কারণ সময় যখন অনেক বেশি প্রতিকূল থাকে তখন অনেক বেশি আশার প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, একথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার আমাদের সবাইকেই একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই ছোট-বড় যে কোনো কাজই যত্নের সাথেই সম্পাদন করতে চেষ্টা করি। যে কোনো কাজের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মহৎ। আমরা যতক্ষণ বাঁচবো ততক্ষণ আশা নিয়েই বাঁচবো। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করবো। আমরা সতর্ক থাকবো। খোদা আমাদের সকলকে নিরাপদে রাখুন। সকলের মঙ্গল কামনা করছি।
জোবায়ের শামীম, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।