অন্যান্য অনেক বছরের মতোই এবছরও বাংলাদেশ দেখা পেল আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের। তবে বাস্তবতার নিরীখে, এবছরের ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতাটি অন্যান্য বছরের তুলনায় রূঢ়তর। বলাই বাহুল্য- এর কারণ কোভিড-১৯ এর বাংলাদেশে পদার্পণ ও বিস্তার। সূচনালগ্ন থেকেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে নির্দেশাবলি আর প্রচারণা সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকসমাজকে দিয়ে এসেছে এবং আসছে, সেই সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বের নজির- তা স্পষ্টতই নির্দেশ করে এ মহামারির বিস্তাররোধ করবার জন্য এই মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব আরও জোরদার করাটাই হলো হাতে থাকা শেষ তাসের শামিল। কিন্তু দফায় দফায় লকডাউনের নিয়ম লঙ্ঘন আর নিয়ম না মেনে চলার সংস্কৃতি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতিকে আরো গুরুতর করে তুলেছে, যেটা আমরা দেখেছি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছেলেখেলার মতো করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজধানীতে আসতে, তারপর আবার নিজ গৃহে ফিরে যেতে বারবার বাধ্য করা এবং শপিংমলের ওপর থেকে “সীমিত পরিসরে” লকডাউন তুলে নেওয়ার মধ্যে। এরই মাঝে প্রকৃ্তির নিয়ম মোতাবেক সুপার সাইক্লোন “আম্ফানে”র আগমন এবং এর মোকাবেলার জন্য ব্যবস্থাপনার সাড়া দেবার ধরণ আমাদের মাঝে আমাদের কাঠামোর প্রতি কিছু জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়।
১৯৭০ সনের “ভোলা সাইক্লোন”-এ বহির্বিশ্বে পূর্ব পাকিস্তানের যে প্রাকৃ্তিক দুর্যোগের কষাঘাতে জরাজীর্ণ অবয়ব উপস্থাপিত হয়েছিল, আজকের বাংলাদেশ তা বেশ কয়েক কদম পেছনে ফেলে এসেছে। এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান এধরনের দুর্যোগে গত ৪০-৫০ বছরে ক্রমান্বয়ে কমে আসা মৃত্যুহার। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো উপকূলীয় অঞ্চলে গড়ে তোলা, মানুষের মধ্যে এ-সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি- এ বিষয়গুলোকে দৃষ্টিগোচর না করে উপায় নেই। এ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো আসলে কতোটুকু নিরাপত্তাবিধায়ক কিংবা সময়ে-অসময়ে এ রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগুলোর আসলে কতোটা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়- তা আমার আজকের রচনার মুখ্য আলোচ্য নয়। আমি শুধু আলোকপাত করতে চাই উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্যোগ-কালীন নিরাপত্তাবিধান নিয়ে। এটা স্পষ্ট যে দুর্যোগ- তা প্রাকৃতিক হোক আর মানবসৃষ্ট- দরিদ্র জনগোষ্ঠী এতে সবচাইতে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত হয়। প্রচলিত সংস্কৃতিতে ‘দারিদ্র্য’ একটি বহুল ব্যবহৃত প্রপঞ্চ হলেও, নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূচক নির্দেশ করে যে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের দারিদ্র্য আর গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্য দুটো আলাদা আলাদা আর্থ-সামাজিক অবস্থান। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রে এ সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস আরও জটিল, কারণ যা যা অর্থসম্পদের অধিকরণ একজন মানুষকে কোন এক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে, তা এখানে প্রতিকূল পরিবেশ প্রতিবেশের কারণে আরও বেশি অস্থিতিশীল। সাম্প্রতিক সময়ের সুপার সাইক্লোন এবং মহামাররি এই উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে এক দ্বি-মুখী সমস্যার সম্মুখীন করে তুলেছে। এতদিনে এটি প্রমাণিত যে কোভিড-১৯ ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ মানে না। একারণেই ইতালি-প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক থেকে আরম্ভ করে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য কিংবা কানাডীয় ফার্স্টলেডি- সকলেই এর অসহায় শিকার। কিন্তু দুর্যোগের প্রাণসংহারী দিক কেবল দুর্যোগে মৃত্যুই নয়, বরং এর নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুও বটে। খাদ্য সংকট, অর্থসংস্থানের অভাব ছিল এতদিন সমপরিমাণে শহুরে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতালব্ধ করোনা-পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। উপকূলীয়দের জন্য এতে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্থাবর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি এবং দেউলিয়া পরিণতি। অ্যাচিল মবেম্বে তাঁর উত্তর-উপনিবেশিকতার আলোচনায় “নেক্রোপলিটিকস” প্রপঞ্চটি বারবার ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্ধারণ করা হয় সমাজের জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ কীভাবে বেঁচে থাকবে, আর অপরাপর অংশের কিভাবে মৃত্যু ঘটবে। রাষ্ট্রের নাগরিকের ভাগ্য নির্ধারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভূমিকা ফুকোডিয়ান ডিসকোর্সেও আলোচিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পেতে আশ্রয়কেন্দ্রে যখন হাজার হাজার পরিবারকে গাদাগাদি করে একসাথে থাকতে হয় জীবনরক্ষার তাগিদে, তখন তাদের সামনে আদতে দুটো পথ খোলা থাকে- হয় ঘূর্ণিঝড়ে মরো, নয়তো করোনা-আক্রান্ত হয়ে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং শুরু থেকেই বাংলাদেশে একধরনের ছেলেখেলার বিষয় ছিলো, সেটা রাষ্ট্রীয় তরফ থেকেই হোক আর নাগরিকদের তরফ থেকে। কিন্তু আম্ফানের আবির্ভাবে আরও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, অন্ততপক্ষে বাংলাদেশের অনেক জনগোষ্ঠীর বাস্তবতায়ই, সামাজিক দূরত্ব-বিধান একধরনের আষাঢ়ে গল্প। একই রাষ্ট্রীয় নাগরিক হওয়া-সত্ত্বেও তাই একটি অংশ যখন রাজধানীতে বসে ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন সন্ধ্যাবেলায় হাই স্পিড ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্গতদের নিয়ে হা-হুতাশ করার সামর্থ রাখেন, আরেকটি অংশ তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর ভাইরাস- দুইয়ের সাথেই যুঝছে।
অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে একতরফাভাবে পরিস্থিতির জন্য দোষারোপ পক্ষপাতিত্বদোষে দুষ্ট হয়ে যায়, যেহেতু প্রাকৃ্তিক দুর্যোগ বা মহামারি- কোনটাই বলেকয়ে আসে না। কিন্তু খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, আপাত প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর জরাজীর্ণ দশা আর অপ্রতুলতার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া, কিংবা স্বাস্থ্যসেবাখাতের নড়বড়ে ভিত্তি দিনেদিনে আমাদের আজ এই অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। একইসাথে দেশের কিছু মানুষ যখন লকডাউন পালন নিয়ে তোড়জোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, কিছু তখন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন- কেউ অজ্ঞতার কারণে, কেউ বা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে। তবে কি বলা যায়, করোনার শারীরিক প্রভাব সামগ্রিকভাবে মনুষ্যজাতির জন্যে এক হলেও, সামাজিকভাবে এর সম্মুখীন হওয়ার ধরণ আর্থ-সামাজিক অবস্থান দ্বা্রাই নির্ধারিত- এবং কোন্ শ্রেণিগোষ্ঠী ঠিক কীভাবে করোনার সম্মুখীন হবে- সেটাও আবার রাষ্ট্র-নির্ধারিত? মহামারি এবং ঘূর্ণিঝড় তবে একসাথেই আমাদের রাষ্ট্র-প্রণোদিত সামাজিক অসমতা আর নেক্রোপলিটিকসের মুখোমুখি আরও একবার দাঁড় করিয়ে দিল।
তাজিন রহমান অনন্যা
প্রভাষক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি)
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।