আনিকা রহমান (২৭) যেদিনই বাসার বাইরে যান সেদিনই তার চোখ-কান চুলকায়, এতে তিনি খুব কষ্ট পান। সাবান পানি দিয়ে তা পরিষ্কার করলেও কমে না বলে তিনি শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউড অ্যান্ড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. তানিয়া তোফায়েলের কাছে যান। চিকিৎসক বলেন, “ঢাকার বাতাসে অদৃশ্য ঘাতক অর্থাৎ যে ধুলোবালি ও জীবাণু রয়েছে এ জন্য এটা হয়ে থাকে। মোটকথা বায়ু দূষণই এ জন্য দায়ী।”
বায়ু দূষণের এই কুফল আমাদের স্বাস্থ্যের উপর আর কীভাবে প্রভাব ফেলছে জানতে চাইলে ডা. তানিয়া আবারো বলেন, “বায়ূ দূষণের জন্য শ্বাসকষ্ট ছাড়াও পেটের সমস্যা, ফুসফুস জনিত সমস্যা, চামড়ার সমস্যা, হাঁপানি বা এলার্জি জনিত সমস্যা, চোখ ও নাকের সমস্যা, যে কোনো সংক্রমণ, গর্ভকালীন সমস্যা এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ দূষণ খুব মারাত্মক প্রভাব ফেলে যা তাদেরকে সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হয়।”
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যত শিশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল তাদের মধ্যে শতকরা ৪৯ ভাগ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর বাতাসে সাধারণত ধুলা ও দূষণ বেড়ে যায়। তবে বর্ষা মৌসুমে শতকরা ৩৫ ভাগ শিশু শ্বাসকষ্টে ভুগেছিল।
ঢাকাবাসীর এই ভোগান্তি যে সত্যি অনেক বেশি মারাত্মক তা বোঝা যায় বায়ু দূষণের আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলো থেকে। সেগুলো বলছে, গত কয়েক বছর থেকে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে চলেছে এবং ঢাকা পৃথিবীর দূষিততম নগরীগুলোর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকছে। তাহলে ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণগুলো কী রকম? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “দেশের অভ্যন্তরে ইটভাটা, শিল্প কারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কালো ধোঁয়া, বস্তিতে প্রায় চল্লিশ লাখ চুলায় আবর্জনা, কাঠ-কয়লা ও কেরোসিন দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও দূরপাল্লার যানবাহনের ধূলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা খোড়াখুড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলার পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণের জন্য এখানকার বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।”
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন বিশ্ববিদ্যালয় ও রচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছেন। এতে বলা হয়, “বাংলাদেশে যে বায়ুদূষণ ঘটছে, তার অন্যতম কারণ আন্তঃসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ। ইরান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তানের শুষ্ক মরু অঞ্চল থেকে ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়। পশ্চিমা লঘুচাপের মাধ্যমে ওই ধূলিকণাসহ বাতাস ভারতে প্রবেশ করে। নভেম্বর থেকে ওই দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে।”
প্রতিবেদনটিতে পরিষ্কারভাবে আরও বলা হয়- “ভারতের কলকাতা, মুম্বাই, পাকিস্তানের করাচি ও বাংলাদেশের ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মারাত্মক যানজট ও ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সেখানে প্রচুর পরিমাণে ধূলাবালিও বাতাসে মিশছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ওই শহরগুলো এই অঞ্চলের বায়ুকে দূষিত করে ফেলছে।”
কারণগুলোই বলে দিচ্ছে এ দূষণ কমানো বা রোধ করা সম্ভব। কিছু নিয়ম, কিছু পরিকল্পনা এবং সমন্বিত উদ্যোগই কমাতে পারে বায়ু দূষণ বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং বায়ু দূষণ গবেষক ড. আব্দুস সালাম।
তিনি বলেন, “ঢাকা শহরে যে যানবাহনগুলো চলে সেগুলো বেশিরভাগই ব্যবহারের অনুপোযোগী। অনেকগুলো গড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ। গাড়িগুলোর যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেগুলো থেকে বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়। উন্নত বিশ্ব ‘কন্ট্রোল ওয়ে’তে দূষণ কমাচ্ছে। তারা পুরানো গাড়ি বাতিল করে দেয়। গাড়িতে তারা উন্নতমানের ইঞ্জিন ব্যবহার করে। আমরা নিন্মমানের ইঞ্জিন ব্যবহার করি। তারা গাড়িতে যে জ্বালানি ব্যবহার করে এর সালফারের মাত্রা ৫০ এর নিচে আমাদের দেশে সেই মাত্রা ২০০০-এর উপরে। তারা ভালো মানের জ্বালানি ব্যবহার করে। তারা ঠিকভাবে গাড়ির মেইনটেন্সেস করে, আমরা তা করি না। ফলে আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রচুর দূষণ হয়।”
শুধু তাই নয়, বিকল্প যানবাহন দূষণ কমায়। ট্রাম বিদ্যুতের মাধ্যমে চলে। মেট্রোরেল ও ইলেকট্রিক কার দূষণ কমায় বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন “এখানে কোনো নিয়মনীতি ছাড়া একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণ কাজ চলতে থাকে। এ কাজে ব্যবহৃত কাঁচামাল ওখানেই তৈরি হয় এবং তা ঢেকে রাখা হয় না। উন্নত বিশ্বে নির্মাণ কাজ অনেক যত্ন এবং কম সময় নিয়ে করা হয়। কাঁচামালগুলো অন্য জায়গায় তৈরি করা হয়। এখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় সারা বছর ধরে এবং মাটিগুলো রাস্তার পাশেই রাখা হয়। ওগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে গার্মেন্টস এবং শিল্প কারখানাগুলোর বর্জ্য থেকেও দূষণ ছড়ায় ব্যাপকভাবে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।”
তিনি আরও জানান, ঢাকার আশেপাশে প্রচুর ইটভাটা রয়েছে এবং সেগুলো দূষণের জন্য কঠিনভাবে দায়ী। অনেক দেশে ইটভাটা নেই। তারা সিমেন্টের তৈরি ব্লক ব্যবহার করে। আমরাও ব্লক ব্যবহার করতে পারি। আমাদের এখানে “ইনডোর এয়ার পলুশন” বেশি হয়। আমরা স্বাস্থ্যসন্মত রান্নাঘর ব্যবহার করি না বলে আমাদের রান্নাঘর থেকেও প্রচুর বায়ুদূষণ হয়। এসব বিষয়ে যদি আমরা সচেতন হই তাহলে দূষণ কম হবে। কাজগুলো অল্প অল্প করে শুরু করতে হবে। এ জন্য সরকারি পর্যায় থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
শুধু স্থানীয়ভাবে ঢাকায় বায়ুদূষণ কমালে কাজ হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এ জন্য তারা আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণ বন্ধ করার বিষয়ে আঞ্চলিকভাবেও উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে সকলকে আগ্রহী হতে বলছেন। নইলে এই অঞ্চলের কোনো দেশের বায়ু দূষণমুক্ত হবে না বলে জানান তিনি। তাই দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে বলে অধ্যাপক সালাম দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “সরকারি পর্যায়ে এ ধরনের আলোচনা এখনো শুরু হয়নি। যদিও উদ্যোগ নেয়ার এটাই প্রকৃত সময়।”
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার অধ্যাপক সালামের সাথে একমত পোষণ করে সহজে কার্যকর করা সম্ভব এমন কিছু উপায়ের কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমাদের এখানে বায়ু দূষণ রোধে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার। খুব সহজ একটা কাজ আছে যা করলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। তা হল ঢাকায় কিছু দূর পর পর ফায়ার ব্রিগেট স্টেশন আছে। সেখান থেকে রাস্তায় পানি দেয়ার ব্যবস্থা করলে বায়ু দূষণ অনেকটাই কমে যাবে। এতে রাস্তার পাশে থাকা গাছগুলোও বৃদ্ধি পাবে এবং অক্সিজেন সরবরাহ ভালো থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে সমন্বয়হীনভাবে গাড়ি ঘোরাঘুরি কমাতে হবে। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কমিশন করা জরুরি। এটা হলে তারা দূষণ রোধে পরিকল্পিতভাবে কাজ করবে। ‘ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট ২০১৯’ হওয়ার কথা। এটা এখনও হয়নি। এটা হওয়া জরুরি। এতে যারা দূষণ বাড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে এবং বায়ু দূষণের পূর্বাভাসও দেয়া যেতে পারে।”
অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, “দূষণ যে কমানো সম্ভব তা করোনাকালীন সময়ের একটি হিসাবের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে পারি। করোনাকালীন সময়ে অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৫ মার্চের পর সাধারণ ছুটির সময় ঢাকায় বায়ু দূষণ কম ছিল। তখন এয়ার ভিজুয়াল পদ্ধতিতে দেখেছি, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ সময় সার্বিকভাবে শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ বায়ু দূষণ কমেছিল। এর কারণ হল, ঐ সময় শতকরা ৭০ ভাগ ইটভাটা ও ৮০ ভাগ নির্মাণ কাজ বন্ধ ছিল। যানবাহন চলাচল এবং অফিস আদালতে এসির ব্যবহারও কম ছিল। এ সময়টাতে আমরা শতকরা ৭৫ ভাগ ভালো বায়ু সেবন করেছি। ঐ সময় আর্টিকুলেটর মিটারে বায়ু দূষণের মাত্রা ছিল ১০৪ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০১৯ সালে এই মাত্রা ছিল ১২৩ মাইক্রোগ্রাম। এ ছাড়া বায়ুমান সূচকে অস্বাস্থ্যকর দিন ছিল ১২ দিন যা ২০১৯ সালে ছিল ২১ দিন।”
তবে দূষণ কমানোর জন্য তিনি যানবাহন-এসি কিংবা নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার কথা বলছেন না। সেগুলো চলবে তবে তা সঠিক নিয়মের মাধ্যমে করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে জানান।
দূষণের জন্য দায়ী যে বিষয়গুলো সেগুলো এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ঢাকাবাসীরা চরম দুর্দশায় পড়ে যাবেন বলে তাদেরকে শঙ্কিত করে তোলার আগেই সাবধান হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ, বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞজনদের অভিজ্ঞতা, পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ আমলে নিতে হবে। করনাকালে দেখা বায়ুদূষণের ইতিবাচক ফলাফল থেকেও আমরা অনেককিছু শিখতে পারি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না