আয়মনা বেগমের (৩৯) স্বামী মারা গেছে সাত বছর হলো। তার চার সন্তান। অভাবের সংসারে খরচ যোগাতে সমস্যা হওয়ায় বড় মেয়েটিকে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। বড় ছেলে চাচাদের সহযোগিতায় কলেজে পড়ছে। ছোটো মেয়েটিকে বিয়ের খরচের আশায় এক আত্মীয়ের বাসায় কাজের লোক হিসেবে রেখে দিয়েছেন এবং ছোট ছেলেটিকে আয়মনা এতিমখানায় দিয়েছেন। আয়মনা নিজে ভাত-কাপড়ের আশায় ভাইয়ের সংসারে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেন। আয়মনা বলেন, “অনেকবার এলাকার মেম্বারকে বলেছি বিধবা ভাতার কথা। তিনি কথা দিয়েও কথা রাখেনননি। এবার উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানকেও বলেছি। কাজ হয়নি। একজন নারী হয়ে তিনি নারীর বেদনা বুঝতে পারলেন না।”
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মোছা. রাবিয়া বেগম ঘটনাটির সাথে একাত্মতা পোষণ করে বলেন, "আমাকেও অনেকে ভুল বোঝেন এবং কাজ করতে পারি না বলে গালিগালাজ করেন। দুই বছর হলো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। অথচ জনগণের উপকারের জন্য কোনো কাজ করতে পারছি না। আমার কাজ শুধু মিটিং করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জনগনের সেবায় কাজ করতে চাই- বিষয়টি অনেকবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বলেছি। তবুও কোনো কাজের সুযোগ পাইনি। মন্ত্রীকে বলেছি, যদি আমাদের কাজের সুযোগ না থাকে তাহলে আমাদের পদটি কেনো সৃষ্টি করা হলো ইত্যাদি। এতেও কোনো কাজ হয়নি।”
তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, “যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি, তাই অনেক সময় তাদের অনেক প্রশ্ন ও জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়। অনেকেই তাদের অসুবিধা বা সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসেন কিন্তু আমি তাদেরকে কোনো সহযোগিতা করতে পারি না। ওরা আমার কাছে দুঃখ করে। আমি কার কাছে দুঃখ করবো? একজন পুরুষ যেমন মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চেয়েছেন, সেভাবে আমিও গিয়েছি। ভিজিএফ, ভিজিটি, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা কিংবা মাতৃত্বকালীন ভাতার জন্য সুপারিশ করলে তা মূল্যায়ন করা হয় না। এতে আমার সন্মানের ক্ষতি হয়। এতে অনেক অসহায় মানুষ বঞ্চিত হন। মিটিংয়ে আমাদেরকে যেভাবে বলা হয় বাস্তবে আমরা তা পাই না। আমি মাসিক ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা পাই। বিভিন্ন মিটিং করি, চা-নাস্তা খাই, কিন্তু কোনো কাজ করতে পারি না। আমি আমার কাজের সুযোগ চাই।”
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কাজী জলি আকতারও একই ধরনের অভিযোগ করে বলেন, “জনগণের প্রতিনিধি হয়েও তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে কিছু করতে পারি না। আমাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই তা আগে জানতাম না। আমাদের কোনো কাজ নেই। আমাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া উচিত। জনগণ অনেককিছু আমাদের কাছে আশা করে। তা আমরা পূরণ করতে পারি না। চেয়ারম্যানরা সহযোগিতা করেন না এবং তারা অবজ্ঞা করে বলেন, তোমাদের কোনো চেক পাওয়ার নেই ইত্যাদি।”
মহিলা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অভিযোগগুলো কতটা সত্যি এবং তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কতটুকু জানতে চাইলে গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাসলিমা বেগম বলেন, “আমার মনে হয় তাদের যথেষ্ট কাজের সুযোগ রয়েছে। আমাদের এলাকায় যে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আছেন তিনি যথেষ্ট সরব এবং কাজ করেন। কোনো বরাদ্দ বা ভাতার বিষয়ে তারা যে সুপারিশ করেন এবং তা দেওয়া হয় না বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা ঠিক নয়। কেননা সেটা নীতিমালা অনুযায়ী উঠে এসেছে কিনা দেখা হয়ে থাকে। সাধারণত যে কোনো ভাতা বা বরাদ্দের বিষয়গুলো ওয়ার্ড পর্যায় থেকে কাজ হয়ে আমাদের কাছে আসে। তারা যে নামগুলো সুপারিশ করেন সেগুলো ভাতা বা বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য কিনা তা যাচাই করা হয়। এটা ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয় না। এর প্রয়োজনীতাকে গুরুত্ব দেয়া হয় এবং তা যথাযথ নীতিমালা অনুযায়ী ঠিক করা হয়।”
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপজেলা ২- এর উপসচিব মোহাম্মদ সামছুল হকও নীতিমালার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, “স্থানীয় সরকার প্রশাসনটি এমনভাবে গঠিত যে তারা নিজেই একটি সরকার- এটা বুঝতে হবে। তাদের নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন আছে যা দিয়ে সন্মিলিতভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ম্যানুয়ালে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা দেওয়া আছে। এই আইনটা খুবই ভালো। নীতিমালাগুলো দিয়ে কাজ করতে হবে। অবশ্যই এক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কাজগুলো বুঝতে হবে এবং সময়মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।”
সামছুল হক যে সক্ষমতার কথা বলেছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা অর্জন করতে হবে বলে জানান চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার সাবেক আইনজীবি ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বানাজা বেগম। তিনি বলেন, “আমার অনেক নারী সহকর্মী কাজের সুযোগ পান না বলে যে অভিযোগ করেন তা অনেকটাই সত্যি। কিন্তু আমি আমার এলাকায় কাজের সুযোগ পাচ্ছি। উন্নয়নমূলক কাজ থেকে শুরু করে সমাজসেবার নানা স্তরে আমি উপজেলা পরিষদের সাথে সন্মিলিতভাবে কাজ করছি। ‘নারী উন্নয়ন ফোরাম’ এডিবি থেকে শতকরা ৩ ভাগ বরাদ্দ পাওয়ার কথা, আমাদের ফোরাম সেটাও পেয়ে থাকে। ম্যানুয়াল যেভাবে আমাদের সুযোগ-সুবিধা বা ক্ষমতা দিয়েছে সেভাবে আমরা পাই না। বলা যায়, এখানে নারীর ক্ষমতায়নে ঘাটতি আছে। এরপরও আমাদের কাজ করে যেতে হবে এবং অধিকার আদায় করতে হবে।”
এজন্য তিনি ১০৩ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলেছেন। তিনি আরও বলেন, “এই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য নানা ধরনের কাজ করছি। শীতাকুণ্ডের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান অফিসে বসতে পারছিলেন না। আমরা তাকে অফিসে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। অনেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের টিএ, ডিএ পান না। এটাও আমরা অ্যাসোসিয়েশেনের মাধ্যমে আদায় করে দিয়েছি। এরপরও সমস্যা আছে। ম্যানুয়াল অনুযায়ী আমরা সপ্তাহে দুইদিন অফিসের গাড়ি ব্যবহার করতে পারবো। কিন্তু বাস্তবে তা পাই না। আমাদের এরকম নানা সমস্যা ও বৈষম্য রয়েছে। এগুলো আমাদের আদায় করতে হবে। আমার এলাকায় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরি জাভেদ আছেন। তার আন্তরিকতা ও সহযোগিতায় আমি অনেক কাজ করতে পারছি। যদিও আমাদের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় আমরা সন্মিলিতভাবে কাজ করছি। তারপরও বলবো মন্ত্রী মহোদয়ের অনুপস্থিতিতে কী করবো জানি না। আগামীতে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বলবো, আমাদের চেক পাওয়ার দিতে এবং কাজের সুবিধার জন্য গড়ি দিতে।"
বানাজার সক্ষমতা থাকলেও তার কণ্ঠে সুক্ষ্ম বঞ্চনা এবং তার এলাকার বর্তমান মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার কী হবে তিনি জানেন না বলে জানান। এতে স্পষ্ট যে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের সক্ষমতা অর্জন করতে হলে অনেক কিছু বুঝতে হবে এবং পরিষদের সাথে সন্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দায়িত্ব-কর্তব্য এবং চেকপাওয়ারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবছেন তারা। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানরা বলছেন, চেকপাওয়ার থাকলে তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে সুবিধা হবে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না