তখন ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এর সবই আম্মার মুখে শোনা। আমাদের চার খালাম্মী আর দুই মামা। আম্মা সবার ছোট। আমাদের নানাবাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার বারোঘড়িয়া গ্রামে। এখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। আমার মামা, খালুরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিলসহ অনেকেই এখানে আসতেন। যুদ্ধের সময় বাড়ির মেয়েদের অন্য এক বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আম্মা তখন কিশোরী। যুদ্ধচলাকালে তার নাক ও কান ফোঁড়ানো হয়। সে যুগে পার্লার ছিল না যে, যাব আর টুপ করে...। গ্রামে এক নারীর হাতে অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার আম্মার নাক-কান ফোঁড়ানো হয়। এরপর তার জ্বর ওঠে। তীব্র জ্বর। এক-দুইদিন না। এক সপ্তাহেও জ্বর নামে না। এই যুদ্ধের মধ্যে কোথায় ডাক্তার, কোথায় কী? তখন পাকিস্তানি আর্মির নারীদের ওপর চালানো নৃশংস নিপীড়নের কথা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার নানা, নানিসহ পুরো পরিবারের দুঃশ্চিন্তা তখন তাদের ছোট মেয়ে অর্থা আমার আম্মা। ছেলে হলে এক কথা। তাকে বাইরে নেওয়া যেত। কিন্তু কিশোরী মেয়েটিকে নিয়ে কোথায় যাওয়া যায়? পরে ঘরে আনা হয় এক কবিরাজ। তার চিকিৎসায় মা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণ গেছে। অনেকে অনেকভাবে সর্বস্ব হারিয়েছেন। কিন্তু আমার আম্মার কাছে যুদ্ধ মানে তার অসুস্থতা। তার সেই জ্বর। তার জন্য পুরো পরিবারটির ব্যাকুলতা। এখন অনন্তলোকে আমাদের নানা, নানি, মামা, খালাম্মীরা। আম্মা তাদের জন্য কাঁদেন। নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে দোয়া করেন।
নিঃসন্দেহে এ আলাপ ব্যক্তিগত। জনযুদ্ধের ব্যাপক প্রেক্ষাপটে তেমন কিছুই না এ ক্ষতি। কিন্তু এটা তো বুঝতে পারি যুদ্ধ হলে মা ভালো থাকেন না।
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ - এর এমন একটি কবিতা আছে। আমার মনের সাথে মিলে যায় যা।
“হাঁসেরা মেঘের সাথে উড়ে
নদীর কাছে আসে।
নদীর প্রসাদ ধান
অঙ্গে সুবাস।
এক ঝাঁক ন্যাংটা বালক
চাপিলার সাথে খেলা করে
মায়ের আঁচলে রোদ
উঠানে ছড়িয়ে ভিজা ধান।
বন্দুক নামিয়ে ফেল
হাঁসকে মেরো না।
মেঘ নিঃসঙ্গ হবে
শিশু নিঃশব্দ হবে
দেশে আকাল হবে
মা দুঃখ পাবে। ’’
: মা দুঃখ পাবে, আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
একটি বিশ্ব মহামারির ভেতর আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি এই বন্দুকের আগ্রাসন। যুদ্ধ আর আকালের আবির্ভাব। সোভিয়েত আমলে দানবখ্যাত ছিল যে কেজিবি (সিআইএ যে ধোয়া তুলসি তা বলছি না) প্রতিভূ পুতিনের হুংকারসহ আক্রমণ। আর ছোট্ট ইউক্রেনের অসহায়ত্ব। একটু হলেও পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা। সঙ্গে থেমে থাকবে কেন অন্য বিশ্ব মোড়লরা? মাঠে নেমে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মতো খেলোয়াড়রা। অনেকে একে আখ্যায়িত করছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধরূপে। অনেকের আশঙ্কা এ যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত ব্যবহার হতে পারে।
আমরা রাত জেগে উয়েফা চ্যাম্পিয়স লিগে ডায়নামো কিয়েভের খেলা দেখি। সেই কিয়েভ এখন বোমায় জর্জরিত। ইউক্রেনের ফুটবল ক্লাব শাখতার দোনেৎস্কের নামও আমাদের অপরিচিত নয়। এর সাবেক পর্তুগিজ কোচ পাওলো ফনসেকা এখন কিয়েভে অবরূদ্ধ।

বৃহস্পতিবার রাশিয়ার সৈন্যরা যখন কিয়েভে হামলা চালায়, ফনসেকা, তার স্ত্রী ও ছেলে তখন এ শহরে ছিলেন। আর বের হতে পারেননি সেখান থেকে। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘আমরা এখন শুধু যা করতে পারি তা হলো প্রার্থনা করা, যেন আমাদের ওপর বোমা না পড়ে। সত্যি বলছি, আমি জানি না, এখান থেকে কীভাবে বেরোতে পারব!’’
খেলার মানুষের কাছে যুদ্ধ এমন। আর যুদ্ধের খেলোয়ারদের কাছে যুদ্ধ কী? যুদ্ধ স্রেফ ব্যবসা। যখনই বিশ্ব পুঁজিবাদ সংকটে পড়ে, তখনই তারা যুদ্ধ লাগায়। অতীতের সব যুদ্ধে তাই হয়েছে। মরেছে গরিব। আর ধন বেড়েছে ধনীদের।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হতে না হতেই অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা গত সাত বছরেরও বেশি সময় পরে এই প্রথম। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশের বেশি গম সরবরাহ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন অঞ্চল থেকে। গম থেকে রুটি হয়। আর বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য রুটি। এমনিতেই লাগাম ছাড়া আমাদের দেশের বাজার। গত কয়েক মাসে কেজি প্রতি আটার দাম ১০ টাকার মতো বেড়েছে। যুদ্ধের প্রভাব তাই বেকারি পণ্যে পড়তে বাধ্য। এই যুদ্ধবাজরা আমাদের গুলিতে মারবে, বোমায় মারবে, অনাহারেও মারবে।
একটি কথা প্রচলিত আছে। তাহলো, যুদ্ধের প্রথম শহিদ সত্য। নির্বিচার প্রাণনাশের নেশায় তথ্য, উপাত্ত নিয়ে কারও হুশ থাকে না। এ বাস্তবতায় ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিক্টর লিয়াশকো গত শনিবার বিবিসিকে জানিয়েছেন, রাশিয়ার হামলায় ৩ শিশুসহ ইউক্রেনের মোট ১৯৮ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ১১৫ জন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন শিশু আছে। এ সংখ্যা আসলে কত তা কে জানে? ইউক্রেনের হাজার হাজার মানুষ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। স্বাধীন দেশের নাগরিক থেকে তাদের পরিচয় আজ ‘‘শরণার্থী’’।
এসব দেখে মনে হচ্ছে, কোনো মুহূর্তেই কবিতা অব্যর্থ নয়। কবিতার সঙ্গে মিলে গেছে বর্তমান।
“ . . .
শিশু নিঃশব্দ হবে
দেশে আকাল হবে
মা দুঃখ পাবে।’’
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখছি, এই সভ্যতাবিরোধী যুদ্ধের বিরুদ্ধে এখনও তেমনভাবে সোচ্চার নন অনেকে। একদমই নয় তা বলছি না। খোদ পুতিনের দেশ রাশিয়ায় রাস্তায় নেমে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে বহু মানুষ। মানবিক মানুষরা প্রতিবাদ করছেন আরও বহু জায়গায়। কিন্তু আমাদের দেশে এ যুদ্ধ নিয়ে তেমন সক্রিয়তা চোখে পড়ছে না। আমাদের চিন্তাটা কী তাহলে? তথাকথিত লাল শিবির যুদ্ধ করলে তা সমর্থনযোগ্য? আর নীল শিবির যুদ্ধ করলে হবে প্রতিবাদ? মানবপ্রাণ ধ্বংসের এমন প্রহরেও যদি আমরা লাল-নীল রঙের রংবাজিতে বিভক্ত থাকি তাহলে আর মানবতার মূল্য কী?
আমরা সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ান কনফেডারেশনের সংকটের খুঁটিনাটি বুঝি না। ন্যাটোর ধান্দা বুঝি না। আমরা শুধু শান্তি চাই। জীবন চাই। প্রাণের পক্ষে আমরা। এখন এই মুহূর্ত থেকে আমরা চাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ। আমাদের গ্রহের অস্তিত্বের স্বার্থে এর কোনো বিকল্প নেই। জন লেননের গেয়ে যাওয়া সেই কবের গান, ‘‘গিভ পিস আ চ্যান্স’’ কি আমরা ভুলে গেছি?
লেখক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। পড়াশোনা করেছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়।
২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই “হুমায়ূনকে নিয়ে” প্রকাশিত হয়।
প্রকাশিত মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। ঢাকা ট্রিবিউন এর জন্য কোনো ধরনের দায় নেবে না।