Wednesday, March 19, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

লাল মোরগের ঝুঁটি: উচ্ছন্নে নয়, আমাদের সিনেমা যুদ্ধে গেছে

প্রতিটি নাগরিককে ছবিটি দেখার ডাক দেওয়া এবং জনযুদ্ধের মূলধারায় ফেরার আকাঙ্ক্ষা এ অভাজনের। হয়তো ৫০ বছরে অনেক দেরি হয়েছে। কিন্তু শুরুতো হলো নিজস্বী চলচ্চিত্র ভাষায় গৎবাধা দৃশ্যের বাইরে ৭১ সালের প্রান্তিক জনপদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, একান্তভাবে আক্রান্ত দশা আর তা প্রতিরোধের গল্প বলা

আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০৭:৫৩ পিএম

ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে মনে রাখার লড়াই মানুষের চিরন্তন। হাজার বছরের রক্ত নদী পেরিয়ে যে নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র পাওয়া, তা কারও দানে নয়। বাঙালির করোটির ভেতর তাই একাত্তরের বিরাজ অহর্নিশ। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের প্রতিরোধে ভেতো বাঙালি সশস্ত্র হয়। ৯ মাসের গেরিলা যুদ্ধের বীরত্বে হার মানে পরাশক্তি। কিন্তু ভুলে থাকা যায় না ক্ষতচিহ্ন। মনে রাখতে হয় এর পথ পরিক্রমা।

দাবায়া রাখতে না পারা জনগোষ্ঠী এমন সময় অতীতে দেখেনি। সেই হিরন্ময় একাত্তর যুগে যুগে কালে কালে বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে ছাপ রেখে চলেছে। শিল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম বিবেচিত চলচ্চিত্র এর ভিন্ন নয়। জনযুদ্ধের নানা আঙ্গিক নিয়ে ছবি হয়েছে। কখনো কাহিনীচিত্র, কখনো প্রামাণ্য- সব মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধকে ধারণের চেষ্টা চলেছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আগামীতেও তা চলবে। লড়াইকালে সেলুলয়েডে যার সূচনা করেন কিংবদন্তি শহীদ জহির রায়হান ও আলমগীর কবির। সে বিবেচনায় বলা যায় বাংলাদেশ ভাগ্যবান। আমাদের ভূমিষ্ঠলগ্নের অনেকটাই পরের প্রজন্মের কাছে দৃশ্য ও শ্রুতমান। ছিল এক অতন্দ্র বেতার কেন্দ্র। তরঙ্গে সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে দিশা দেখানো যার ধর্ম ছিল।      

তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, গর্বের শুরুর ধারাবাহিকতায় উত্তরসূরিরা কতটুকু হেঁটেছেন? রাজনীতিবিদদের জাত আমাদের চেনা। দীর্ঘ সামরিক শাসন আর ‘‘পিতা’’, ‘‘ঘোষক’’ বাজে তর্কে রাষ্ট্র ক্ষমতা ৫০ বছর দুইটি পরিবারের আয়ত্তেই থেকেছে। ‘‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’’র নামে এ মুহূর্ত পর্যন্ত যা চলছে তার মূলছিন্ন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট। তার চেয়ে ভয়ংকর দিকও আছে এর। এখানে মাটি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি দায়নিষ্ঠ সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা কেমন যেন আবছা লাগে। বিশেষত ৯০ উত্তর সময়ে।

দেশের বরেণ্য, প্রণম্য চলচ্চিত্র নির্মাতারা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে থেকেই অম্লান জনযুদ্ধকে লেন্সে ধারণ করেছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে কি সিনেমাযাত্রায় একাত্তর ছেদ পড়ে? একাত্তর উন্মূলে ব্যস্ত গোষ্ঠী দীর্ঘসময় ক্ষমতাসীন; এ-ও কি এর কারণ? হয়তো ইতিহাস এর জবাব দেবে। কিন্তু স্বাধীনধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের কর্মীরা থেমে ছিলেন না। রক্তঝরা ক্ষণ নিয়ে এফডিসিতেও নির্মিত হয়েছে অনেক ছবি। তাদের প্রতি ঋণ অশোধ্য। কারণ প্রকৃত শিল্পী বিশ্বাস করেন, নতুন সৃজনে অনুকূল পরিবেশ বলে কিছু নেই। প্রতিকূলতায় প্রতিরোধই শিল্পের গতিপথ।

তবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের নামে বীরত্বের প্রতি চরম অবমাননা কম হয়নি। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় রাষ্ট্রিয় অনুদানের ছবি নিয়ে চলেছে লুটের মচ্ছব। শুধু বড় পর্দায় নয়। টেলিভিশন মাধ্যমেও একাত্তর চিত্রিত হয়েছে। নতুন সিনেমার স্বাপ্নিকরা সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সব মাধ্যমেই একাত্তর ধারণের সক্ষমতা নিয়ে ছবির দর্শক হিসেবে প্রশ্ন তোলার অধিকার আছে প্রত্যেকের। জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি গণ্য অনন্য নেতার মহাকাব্যিক ভাষণ ও একটি নির্দিষ্ট দলকে তোষণ প্রবণতা অনেক ছবিতে চাক্ষুষ হয়।

শেখ মুজিব গর্জে উঠেছিলেন এই ডাকে -“ . . .কী পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলি। . . .”

আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের মতো চলচ্চিত্রও যেন বেঈমানি করে এ শহরের লেক পাড়ের ৩২ সড়কে সপরিবারে শহীদ হওয়া নেতার প্রতি। তৈরি হয় আর তা লাগাতার কপি পেস্ট হতে থাকে একটি ফর্মূলায়। একটি ভাষণ, খোলামেলা ধর্ষণদৃশ্য, দাড়ি টুপিধারী রাজাকার আর থ্রিনট থ্রি হাতে লাফিয়ে পড়া যার রসায়ন। একাত্তর নিয়ে বছরের পর বছর নির্মিত এমন ছবি থেকে এক সময় মুখ ফিরিয়ে নেয় তারুণ্য। জাতির উত্থান পর্ব এভাবে গ্লানিতে ডোবে। কেউ কি বলতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত কোনো একটি ছবির নাম যা বক্স অফিসে আলোড়ন তুলেছে? আর মাসব্যাপী তা চলেছে সর্বজন সমাগমের সিনেমা হলে? কার, কোন পাপে একাত্তর বিযুক্ত হলো আগামীর দেশচালক প্রজন্ম?

এই বাস্তবতায় হীরালাল সেন থেকে শুরু হওয়া বাংলা ছবির ইতিহাসে অভূতপূর্ব সংযোজন নূরুল আলম আতিকের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত ও মাতিয়া বানু শুকু প্রযোজিত ছবি ‘‘লাল মোরগের ঝুঁটি’’। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের অনুদান পায় এ সিনেমা। অসীম মমত্বে তৈরি ১০৫ মিনিটের এ ছবি এখন হলে। তা দেখার সৌভাগ্যকে বিরাজমান প্রবণতার বাঁক বদলের সাক্ষ্য হিসেবে মনেকরি। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে মুক্তি পাওয়া ‘‘লাল মোরগের ঝুঁটি’’ এখন প্রদর্শিত হচ্ছে বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্স, সীমান্ত সম্ভারের সিনেপ্লেক্স, মিরপুর সনি সিনেপ্লেক্স, মহাখালী এসকেএস টাওয়ার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার, নারায়ণগঞ্জের সিনেস্কোপ ও খুলনার লিবার্টি সিনেপ্লেক্সে।

‘‘লাল মোরগের ঝুঁটি’’ সিনেমার রিভিউ দেওয়া এ লেখনীর উদ্দেশ্য নয়। বরং প্রতিটি নাগরিককে ছবিটি দেখার ডাক দেওয়া এবং জনযুদ্ধের মূলধারায় ফেরার আকাঙ্ক্ষা এ অভাজনের। হয়তো ৫০ বছরে অনেক দেরি হয়েছে। কিন্তু শুরুতো হলো নিজস্বী চলচ্চিত্র ভাষায় গৎবাধা দৃশ্যের বাইরে ৭১ সালের প্রান্তিক জনপদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, একান্তভাবে আক্রান্ত দশা আর তা প্রতিরোধের গল্প বলা। ‘‘বাঘা’’ নামের লাল মোরগের ডাক যেন আমাদের হুশ ফেরায়। মাল্টিপ্লেক্সের টিকিট কাউন্টারে দেখলাম এ ছবির চেয়ে স্পাইডারম্যান দেখতে আমাদের শিশু ও তরুণদের ভিড় বেশি। আমরা যেন এই আগামীর জাতি নির্মাতাদের বলতে পারি, তোমরা বিমুখ হয়ো না। বাংলা ছবি উচ্ছন্নে যায়নি; বরং বাংলা ছবি যুদ্ধে গেছে। ‘‘কল অফ দ্যা রেড-রুস্টার’’ এর ডাক আমাদের চিন্তার জগতে ঘুম ভাঙাক।



ফ্রিল্যান্স লেখক ও সাংবাদিক হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। পড়াশোনা করেছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়।

২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই “হুমায়ূনকে নিয়ে” প্রকাশিত হয়।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনো ধরনের দায় নেবে না।

   

About

Popular Links

x