রাজধানী ঢাকা আর ফেরিওয়ালা-দুটোর সম্পর্ক বহুদিনের। নগরীর রাস্তায়, গলির কোণে এমনকি বাস-ট্রেনেও বিভিন্ন সুরে ছড়া কেটে জিনিসপত্র বিক্রি করতে দেখা যায় ফেরিওয়ালাদের। আবাসিক এলাকাগুলোতে ফেরিওয়ালারা যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতের গোড়ায় এনে দেয়, তেমনই জানজটের রাস্তায় তাদের সুবাদে অনেক সময় দূর হয় ক্লান্তি।
রাস্তার ফেরিওয়ালাদের কাছে মেলে হরেক রকমের জিনিস। আর সম্প্রতি সেগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে বই। নানা ধরনের এসব বই পড়ে থেমে থাকা ঢাকার রাস্তায় কেটে যাচ্ছে নগরীর বাসিন্দাদের সময়, থেমে যায় ঝিমুনি।
কিন্তু ফেরি করে রাস্তায় রাস্তায় খেলনা কিংবা পানি বিক্রি করার চেয়ে বই বিক্রি বেশ আলাদা। কারণ, ফেরিওয়ালারা বলতে গেলে শিক্ষার ছোঁয়া পায় না। তাদের পক্ষে শিক্ষার ধারক বই বিক্রি করা কঠিন বলতেই হবে।
এরপরও কীভাবে ফেরিওয়ালা ক্রেতাদের পছন্দের বইগুলো খুঁজে আনছে, আর কীভাবেই সেগুলো তারা মূল দামের অর্ধেকে দিচ্ছে তা অবাক করার মতো বটে।
‘ইংরেজি বইয়ে লাভ বেশি’
রাজধানীর ব্যস্ততম বিজয় সরণীতে বই বিক্রি করেন মো. গফুর সরদার। তবে তিনি আর ১০জন ফেরিওয়ালাদের চেয়ে আলাদা। কারণ অনেক বছর আগে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় একটি হাত হারান তিনি। তারপর থেকেই গফুর এই পেশায়। তিনি ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করছেন ৩০ বছর ধরে।
গফুর জানান, এর আগে ঢাকার রসুলবাগ এলাকায় সিগারেট বিক্রি করতেন । পরে আরেক ফেরিওয়ালার পরামর্শে বই বিক্রিতে নামেন তিনি। ‘আমি বই বিক্রি শুরু করি যখন হিলারি ক্লিনটনের বই লিভিং হিস্টোরি বাজারে আসে’, বলেন বৃদ্ধ এই বই বিক্রেতা।
গফুর বলেন, ‘আমি সাধারণত মনিকা আলীর বই বিক্রি করি। এ ছাড়া মাহথির মুহাম্মদ ও প্রিন্সেস ডায়ানার জীবনীও রয়েছে। পাশাপাশি জীবনানন্দ দাস ও শরৎচন্দ্রের বাংলা বইও বিক্রি করে থাকি। তবে ইংরেজি বই বিক্রি করে লাভ করা সহজ।’
গফুরের মতো আরেকজন ফেরিওয়ালা ফয়জুল। তিনি গুলশান-২ এলাকায় বই বিক্রি করেন। ফয়জুলঅ জানান, তাদের বাজারে ইংরেজি বইয়ের চাহিদা বেশি।
তিনি বলেন, ‘আমরা বেশি টাকার জন্য ইংরেজি বই বিক্রি করতে পারি। তবে লোকজন তা কেনেও বেশি। কারণ, আমরা বইগুলোর নকল কপি বিক্রি করি, সেগুলো দোকানে অনেক বেশি দাম। আমরা ১ হাজার ২০০ টাকা দামের ইংরেজি বই ২০০ টাকায় বিক্রি করতে পারি। আর বাংলা বই তো আপনি যে কোনো জায়গায় পাবেন।’
পাইকারি দামে বই কিনতে ফেরিওয়ালা সাধারণত নীলক্ষেত অথবা বাংলাবাজার যান। ক্রেতাদের বইয়ের চাহিদা সম্পর্কে ফয়জুর বলেন, “কোন বইগুলো ক্রেতারা বেশি পছন্দ করেন তা সম্পর্কে তারা সহজেই ধারণা পেয়ে যান। কোনো কোনো সময়ে মানুষ জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি কেন এই বইটি রাখেন না?’ তাই আমরা ওই বইয়ের নাম টুকে নেই আর নীলক্ষেতে গিয়ে ওই বইগুলো দিতে বলি।”
কিন্তু লেখাপড়া না জেনেও কীভাবে বইগুলর নাম টুকে নেন তারা? এমন প্রশ্নের জবাবে মুচকি হেসে ফয়জুর বলেন, ‘এটা শুধুই অভ্যাস। আমাদের ক্রেতারা ওই বইগুলোর নাম প্রায়ই বলেন। আমরা শুরু সেগুলো মুখস্থ করে নেই।’
নীলক্ষেতের গল্প
নীলক্ষেত যেন বইয়ের রাজ্য। শত শত দোকানে হাজার হাজার পদের বই। নীলক্ষেতে সাধারণ ক্রেতাদের পাশাপাশি ভীড় জমে ফেরিওয়ালাদেরও। তাজিন বই ঘরের মালিক আবদুল মতিন বলেন, ‘আমার দোকানে প্রতিদিন ৮-১০ জন ফেরিওয়ালা আসে। আমাদের কাছে যেসব ইংরেজি বই থাকে সেগুলো আমরা তাদের দেই। তারা সেগুলো বিক্রির চেষ্টা করে। বাকিগুলো ফেরত নিয়ে আসে।’
মতিন বলেন, মানুষ ইংরেজি বই পড়তে চায়। কারণ তারা ভালভাবে জানে এই শহরে ইংরেজি জানলে তার বিনিময়ে ভালই পাওয়া যায়।
জানা যায়, নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানিরা প্রথমে একটি ইংরেজি বইয়ের মূল কপিটা কেনেন। পরে সেটি বাংলাবাজারের ছাপাখানা থেকে কপি করেন। এর ফলেই কমদামে সেগুলো বিক্রি করা হয়।
সাইদুল নামের এক দোকানি বলেন, এক সময় তারা ভারত থেকে বই আনতেন। তবে এখন সেগুলো পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র ও বাতি ঘরের মতো বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়। সেখান থেকে বই কিনে তারা ছাপাখানা থেকে ছাপিয়ে নেন।
মোল্লা বুকসের ব্যবস্থাপক মেহেদি হাসান বলেন, স্থানীয় বইয়ের বাজারে ইন্টারনেটের ফলে বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন আর বই কিনতে দোকানে যাওয়া লাগে না। মানুষ এখন পিডিএফ ডাউনলোড করে নেয়। এ ছাড়া অনলাইনে দেখা যায় বিদেশি বাজারে কোন বইগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। আর সেগুলোই ডাউনলোড করা হয়।