কাতার বিশ্বকাপ শুরু হতে খুব বেশি সময় বাকি নেই। বিশ্বকাপ যতই এগিয়ে আসছে, ততই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কোন দল শিরোপা জয়ের জন্য ফেবারিট কিংবা কোন দলগুলো চমক দেখাতে পারে, তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা।
এরই মধ্যে একটা বিষয় হলো বিশ্বকাপে আফ্রিকান দেশগুলোর সম্ভাবনা নিয়ে। বরাবরের মতো এবারের বিশ্বকাপে ৫টি আফ্রিকান দল অংশ নিতে যাচ্ছে। আফ্রিকান অঞ্চল থেকে আসন্ন কাতার বিশ্বকাপে অংশ নিতে যাচ্ছে তারা হলো- ক্যামেরুন, মরক্কো, তিউনিসিয়া, ঘানা এবং সেনেগাল।
জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে আফ্রিকা মহাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশ্ব ফুটবলকে বিভিন্ন সময়ে এক ঝাঁক তারকা উপহার দিয়েছে আফ্রিকা। যুব বিশ্বকাপ থেকে অলিম্পিক ফুটবলেও আফ্রিকান দেশগুলোর সাফল্য কম নয়। কিন্তু ফিফা বিশ্বকাপে আফ্রিকান দেশগুলোর বড় কোনো সাফল্য নেই।
ফিফা বিশ্বকাপে ৩২ দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এশিয়া থেকে মাত্র ৪টি দেশ অংশ নিয়ে থাকে। সেই এশিয়া মহাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেছে। অথচ ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকানদের পর উন্মাদনায় ভোগা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আজ পর্যন্ত কোনো দল শেষ চারে জায়গা করে নিতে পারেনি।
১৯৩৮ বিশ্বকাপে মিশরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোনো আফ্রিকান দল ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে আফ্রিকা মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। এরপর একে আরও ১২টি আফ্রিকান দেশ ফিফা বিশ্বকাপে পা রাখে। কিন্তু বিশ্বকাপে আফ্রিকান দলগুলোর সর্বোচ্চ সাফল্য কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া পর্যন্তই।
আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে ফিফা বিশ্বকাপের শেষ আটে পা রাখার কীর্তি গড়ে দেখিয়েছে শুধুমাত্র ক্যামেরুন, সেনেগাল এবং ঘানাই। এছাড়া অন্যান্যা আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে মরক্কো, নাইজেরিয়া এবং আলজেরিয়া গ্রুপপর্বের বৈতরণী পার হতে পেরেছে।
চলুন তাহলে একনজরে দেখে নিই ফিফা বিশ্বকাপে কোন কোন দলগুলো সাফল্য পেয়েছে-
ক্যামেরুন (১৯৯০)
তুলনামূলক কম গোল, রক্ষণাত্মক ফুটবল এবং লাল কার্ডের আধিক্যের জন্য অন্যান্য আসরের চেয়ে ১৯৯০ বিশ্বকাপ কিছুটা ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছিল। তবে ইতালিতে অনুষ্ঠিত সেই আসরে আলোর উৎস হয়ে এসেছিল ক্যামেরুন। গ্রুপপর্বে ডি গ্রুপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রোমানিয়াকে পেয়েছিল আফ্রিকান দেশটি।
সেবার ক্যামেরুনকে নিয়ে বাজি ধরার মতো লোক কমই ছিল। তবে টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে তারা। দ্বিতীয়ার্ধে দলের দুজন লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেও আলবিসেলেস্তেদের পরাজিত করতে সমর্থ হয়েছিল অদম্য সিংহ নামে পরিচিত দলটি।
পরের ম্যাচে রোমানিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিয়ে ক্যামেরুন জানিয়ে দেয় টুর্নামেন্টে তারা শুধু অংশগ্রহণের জন্যই আসেনি। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ০-৪ গোলে বিধ্বস্ত হলেও প্রথম রাউন্ডের বৈতরণী পার হয় আফ্রিকান দেশটি।

দ্বিতীয় রাউন্ডে ক্যামেরুনের প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়া। নির্ধারিত সময় শেষে ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়ালে সেখানে লাতিন আমেরিকানদের বিরুদ্ধে ২-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ক্যামেরুন। সেই সঙ্গে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখে তারা।
তবে সেবার ক্যামেরুনের স্বপ্নযাত্রা থেমে যায় শেষ আটেই। কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। ম্যাচের প্রথমার্ধে ইংলিশরা এগিয়ে গেলেও দ্বিতীয়ার্ধে চার মিনিটে দুই গোল করে এগিয়ে যায় ক্যামেরুন। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ৭ মিনিট আগে গ্যারি লিনেকার ১৯৬৬ সালের চ্যাম্পিয়নদের সমতায় ফেরান। পরে অতিরিক্ত সময়ে আরও একটি গোল করে ক্যামেরুনের বিশ্বকাপ যাত্রায় ইতি টেনে দেন ইংলিশ কিংবদন্তি।
১৯৯০ বিশ্বকাপে ৪ গোল করে ক্যামেরুনকে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত টেনে নেওয়ার বড় কৃতিত্ব ছিল রজার মিলার। গোলের পর কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে কোমর দুলিয়ে ঐতিহাসিক গোল উদযাপনের জন্ম দেওয়া এ ফরোয়ার্ড সেবারের আসরে বিশ্বকাপের বয়োজ্যেষ্ঠ গোলদাতা হওয়ার রেকর্ড গড়েন। পরবর্তীতে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে তিনি নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়েন, যা টিকে আছে আজও।
সেনেগাল (২০০২)
একবিংশ শতাব্দীতে অনুষ্ঠেয় প্রথম বিশ্বকাপে অন্যতম চমক জাগানিয়া দল ছিল সেনেগাল। ২০০২ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে খেলতে এসেই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সঙ্গে উরুগুয়ে এবং ডেনমার্কের সঙ্গে শক্ত একটি গ্রুপে পড়ে সেনেগালিজরা।
সেবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ঠিকই হট ফেবারিট ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে বড় অঘটনের জন্ম দেয় সেনাগাল। পরের ম্যাচে ডেনমার্কের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও ১-১ গোলের ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে তারা। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে এক পর্যায়ে ৩-০ গোলে এগিয়ে গেলেও ৩-৩ গোলে ড্র নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় সেনেগালকে। তবে প্রথম পর্বের বাধা ডিঙাতে আফ্রিকান দলটির জন্য সেটিই ছিল যথেষ্ট।

দ্বিতীয় পর্বে সেনেগালের প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিল আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ডের মতো দলকে টপকে গ্রুপপর্ব পার করে আসা সুইডেন। নির্ধারিত সময়ের পর ১-১ গোলে অমিমাংসিতভাবে শেষ হলে ম্যাচটি গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে গোল্ডেন গোলের মাধ্যমে সুইডিশদের ২-১ গোলে হারিয়ে ক্যামেরুনের পর দ্বিতীয় আফ্রিকান দল হিসেবে শেষ আটে পা রাখে সেনেগাল।
তবে যে গোল্ডেন গোলের বদৌলতে সেনেগাল কোয়ার্টার ফাইনালে এসেছিল, সেই গোল্ডেন গোলই তাদের অবিস্মরণীয় বিশ্বকাপ যাত্রাপথের হন্তারক হয়ে দাঁড়ায়। তুরস্কের বিপক্ষে শেষ আটের লড়াইয়ে গোলশূন্য নব্বই মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে গোল্ডেন গোল হজম করে সেনেগালিজরা। ফলে সেবার তৃতীয় হওয়া তুর্কিদের কাছে হেরেই বিদায় নেয় আফ্রিকান দেশটি।
ঘানা (২০১০)
২০১০ সালে প্রথমবারের মতো আফ্রিকা মহাদেশে বসেছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। সেবার আফ্রিকান দেশগুলোকে সবার ছিল বাড়তি আগ্রহ। তবে ঘানা ব্যতিত আর কোনো আফ্রিকান দলই প্রথম রাউন্ডের বাধা ডিঙাতে পারেনি। গ্রুপপর্বে সেবার ঘানার সঙ্গী ছিল জার্মানি, সার্বিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া।
নিজেদের প্রথম ম্যাচে সার্বিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়ে টুর্নামেন্টে শুভসূচনা করে ঘানা। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে আফ্রিকান দেশটি। শেষ ম্যাচে শক্তিশালী জার্মানির কছে ০-১ গোলে হেরে গেলেও সেবার একমাত্র আফ্রিকান দল হিসেবে নকআউট পর্বে পা রাখে ঘানা। কারণ গ্রুপপর্বে শেষে ঘানা এবং সার্বিয়া দুই দলেরই পয়েন্ট সমান চার হলেও গোল ব্যবধানে এগিয়ে ছিল আফ্রিকান দেশটিই।
আর কোনো আফ্রিকান দল প্রথম রাউন্ড টপকাতে না পারায় আফ্রিকানদের আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে ঘানা। সেই ভরসার প্রতিদানও দারুণভাবেই দিচ্ছিলো ঘানাইয়ানরা। দ্বিতীয় রাউন্ডে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিরিক্ত সময় শেষে ২-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয় এবং সর্বশেষ আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখে ঘানা।
ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখছিল ঘানা। নিজেদের মহাদেশে আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপে তাহলে দারুণ কিছু উপহার পেতো আফ্রিকাও। তবে উরুগুয়ের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের নিদারুণ প্রবঞ্চনার শিকার হতে হয়েছিল ঘানাকে।

শেষ ষোলোর মতো নির্ধারিত সময় শেষে ম্যাচ ১-১ গোলে অমীমাংসিত থাকায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের একদম শেষ মুহূর্তে ঘানার নিশ্চিত গোল হাত দিয়ে আটকে দেন উরুগুয়ের লুইস সুয়ারেজ। পেনাল্টি পেলেও সেখান থেকে ঘানা গোল করতে ব্যর্থ হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি মিসটা ঘানার আত্মবিশ্বাসে এতটাই ধাক্কা দেয় যে, টাইব্রেকারে দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের কাছে ৪-২ গোলে বেদনাদায়কভাবে হেরে যায় তারা।
নাইজেরিয়া (১৯৯৪, ১৯৯৮, ২০১৪)
একমাত্র আফ্রিকান দেশ হিসেবে ফিফা বিশ্বকাপে তিনবার গ্রুপপর্বের বাধা পেরোনোর কীর্তি আছে শুধুমাত্র নাইজেরিয়ারই। ১৯৯৪ সালে প্রথম বিশ্বকাপে খেলার স্বাদ পাওয়া নাইজেরিয়া সেবার আর্জেন্টিনা, বুলগেরিয়া এবং গ্রিসের গ্রুপে পড়েও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নকআউট রাউন্ডে পা রাখে। যদিও দ্বিতীয় পর্বে ইতালির বিপক্ষে এগিয়ে গিয়েও অতিরিক্ত সময় শেষে হেরে বিদায় নিতে হয় তাদের।
স্পেন, প্যারাগুয়ে এবং বুলগেরিয়ার গ্রুপসঙ্গী হলেও ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত পরের বিশ্বকাপেও সবার ওপরে থেকেই গ্রুপপর্বের বাধা পেরোয় নাইজেরিয়া। দ্বিতীয় রাউন্ডে অবশ্য ডেনমার্কের কাছে ১-৪ গোলে উড়ে যায় আফ্রিকান দেশটি।

১৬ বছর পর ২০১৪ সালে আবারও বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে পা রাখে নাইজেরিয়া। তবে এবার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে না, বসনিয়া এবং ইরানের বাধা টপকে আর্জেন্টিনার পেছনে থেকে প্রথম রাউন্ড পার করে নাইজেরিয়ানরা। যদিও তাদের কাটা পড়তে হয় শেষ ষোলোতেই। ফ্রান্সের কাছে ০-২ গোলে হেরে সেবার তাদের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হয়।
আলজেরিয়া (২০১৪)
১৯৮২ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপে এসে আলোড়ন তুললেও পশ্চিম জার্মানি আর অস্ট্রিয়ার কুটকৌশল আর চক্রান্তে সেবার নকআউট পর্বে পা রাখতে পারেনি আলজেরিয়া। ২০১৪ সালে অবশ্য বেলজিয়াম, রাশিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার গ্রুপসঙ্গী হয়ে প্রথম রাউন্ডের বাধা টপকায় আফ্রিকান দেশটি। যদিও শেষ ষোলোতে সেবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির কাছে অতিরিক্ত সময় শেষে ১-২ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয় আলজেরিয়ানদের।

মরক্কো (১৯৮৬)
১৯৮৬ বিশ্বকাপকে সবাই ডিয়েগো ম্যারাডোনার অতিমানবীয়তার কারণে মনে রাখলেও সেবারের আসরের অন্যতম বড় চমক হয়ে এসেছিল মরক্কো। ইংল্যান্ড, পর্তুগাল আর পোল্যান্ডের সঙ্গে কঠিন গ্রুপে পড়েছিল তারা। তবে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে আর পর্তুগিজদের হারিয়ে দিয়ে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে ওঠে মরক্কো। শেষ অব্দি অবশ্য মরক্কানদের দৌড় থামে দ্বিতীয় পর্বেই, সেবারের রানার্সাপ পশ্চিম জার্মানির কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে।
