গোলমুখের সামনে রবার্ট লেভানডফস্কি কেমন ভয়ঙ্কর, সেটি আর নতুন করে বলে দেওয়ার কিছু নেই। ক্লাব হোক আর জাতীয় দল, ৩৪ বছর বয়সী স্ট্রাইকারের গোলক্ষুধা সর্বদাই তীব্র। এ মৌসুমে বার্সেলোনায় যোগদান করা পোলিশ ফরোয়ার্ড সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১৪ ম্যাচ খেলে করে ফেলেছেন ১৭ গোল।
জাতীয় দল পোল্যান্ডের হয়েও লেভানডফস্কি একই রকম দুর্বার। পোল্যান্ডকে কাতার বিশ্বকাপে নিয়ে যেতে বাছাইপর্বে ৯ ম্যাচে ৯ গোল করেছেন তিনি। সুইডেনের বিপক্ষে বাঁচা-মরার প্লে-অফ ম্যাচেও গোলের দেখা পেয়েছিলেন এই স্ট্রাইকার। তবে বর্তমান সময়ের অন্যতম নিখুঁত গোলশিকারী হলেও ‘‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ'' খ্যাত বিশ্বকাপ ফুটবলে তিনি এখনও গোল করতে পারেননি।
২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে পোল্যান্ডের জার্সিতে প্রথমবারের মতো ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে পা রেখেছিলেন লেভানডফস্কি। কিন্তু গোলহীন পোলিশ স্ট্রাইকার বিশ্বকাপে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। ফলশ্রুতিতে পোল্যান্ডও বিদায় নিয়েছিল গ্রুপপর্ব থেকেই।

দুয়ারে কড়া নাড়ছে আরেকটি ফিফা বিশ্বকাপ। গতবারের মতো এবারও পোল্যান্ডের অধিনায়কত্বের ভার লেভানডফস্কির বাহুতেই। আসন্ন কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে লেভানডফস্কির চিন্তাভাবনা, পোল্যান্ডের সম্ভাবনা এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পোলিশ স্ট্রাইকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল ফিফা। পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেই আলাপচারিতা-
ফিফা: গোলসংখ্যা এবং পারফরম্যান্সের বিচারে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব আপনার জন্য কেমন গিয়েছিল?
লেভানডফস্কি: বাছাইপর্বে আমরা প্রচুর গোল করেছি। এমনকি আমিও প্রথম ম্যাচে গোল করে দলকে এক পয়েন্ট এনে দিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর কয়েকটি ম্যাচ আমাদের জন্য সহজ ছিল না। এটি পরিষ্কার যে বাছাইপর্বে জয়ই শেষ কথা, সেটি কীভাবে এলো তা কোনো বিষয় না।
আমি সবসময় মাঠে নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে গোল করতে কিংবা সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই। কারণ মাঠে আমার নৈপুণ্য ম্যাচে প্রভাব রাখতে সক্ষম। আমি যদি গোল করে দলের জয়ে ভূমিকা রাখতে পারি, তাহলে সেটি দুর্দান্ত। তবে আমার গোল ছাড়া দলের জয় এলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ দলের জয়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ফিফা: আপনি গত দুই বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব মিলিয়ে ১৯ ম্যাচ খেলে ২৫ গোল করেছেন। কাতার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ৯ ম্যাচে ৯ গোল করেছেন। গোল করাটা আপনার জন্য ডালভাত হলেও গোলসংখ্যাটা নিশ্চয়ই দুর্দান্ত?
লেভানডফস্কি: বাছাইপর্বে অনেকগুলো গোল করতে পেরে আমি খুব আনন্দিত। আমি জানি আমার প্রতিটি গোলই পোল্যান্ডকে জয়ের বন্দরে ভেড়াতে সহায়তা করে। তাই আমি এত গোল করে আমি ভীষণ খুশি এবং গর্বিত।

ফিফা: আপনার পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা রীতিমত ঈর্ষণীয়। এটা কী আপনার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে?
লেভানডফস্কি: অবশ্যই, আমি জানি নিজের প্রতিটি গোলের পরেই আমার কাছে সবার প্রত্যাশা বাড়ে। প্রতিপক্ষ যেই হোক, আমার কাছ থেকে সবাই সবসময় গোল চায়। কিন্তু প্রতি ম্যাচেই গোল করা সম্ভব না। আমি জানি আমার গোলক্ষুধা সবসময় থাকা উচিত।
আমার পরিসংখ্যান দেখে অনেকেই ভাবে, গোল করলেই বোধহয় আমি ভালো খেলেছি। আর যদি গোল না করি, তাহলে তাদের ধারণা যে আমি বাজে খেলেছি। তবে আমি জানি ব্যাপারটি মোটেও সেরকম না। কাজেই এটা আমাকে ভাবায় না।
ফিফা: ১৯৭৪ আর ১৯৮২ বিশ্বকাপের পোল্যান্ডের স্কোয়াডটি সেই যুগের অন্যতম শক্তিশালী দল ছিল। বিশ্বকাপেও তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। পোল্যান্ডের বর্তমান দলটি কী সেই স্কোয়াড দেখে কাতার বিশ্বকাপের জন্য অনুপ্রেরণা পেতে পারে?
লেভানডফস্কি: তখনকার ফুটবলের সঙ্গে বর্তমান সময়ের ফুটবলের তুলনা করা কঠিন। তখনকার সাফল্য পোল্যান্ডকে তৎকালীন সময়ের সেরা দল বানিয়েছিল। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে বৃষ্টিসিক্ত ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির কাছে এবং ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালির কাছে সেমিফাইনালে না হারলে পোল্যান্ডই সেই দুবার যোগ্য দল হিসেবে শিরোপা জিততে পারতো।
তবে যুগের সঙ্গে সময় পরিবর্তন হয়েছে। ফুটবলের বিবর্তনের সঙ্গে অনুশীলনের পদ্ধতিও এখন ভিন্ন। তবুও আমরা সবসময় নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব যেন সমর্থকরা আমাদের নিয়ে গর্বিত হতে পারে।
ফিফা: জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৪ বিশ্বকাপে পোল্যান্ডের গ্রেগ্রোজ লাটো গোল্ডেন বুট (সর্বোচ্চ গোলদাতা) জিতেছিলেন। কাতার বিশ্বকাপে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারলে আপনার কাছে কেমন লাগবে?

লেভানডফস্কি: মাঠে আমি সুযোগ পাওয়ামাত্রই গোল করার চেষ্টা করি। তবে গ্রেগ্রোজ লাটোর সমানসংখ্যক গোল করাটা বেশ কষ্টকর হবে। যদিও আমরা এমন দল নই, যারা ম্যাচে বিপুল সংখ্যক গোলের সুযোগ সৃষ্টি করে থাকে। তবে গোল করার কয়েকটি সুযোগ এলেও আমরা গোলের জন্য ক্ষুধার্ত থেকে যতটা সম্ভব সেগুলো গোলে পরিণত করব। তবে এটা বিশ্বকাপ। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের অবস্থান সবসময় দলের পেছনেই থাকে।
ফিফা: ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব থেকে পোল্যান্ডের বিদায়ে আপনি কেমন হতাশ ছিলেন?
লেভানডফস্কি: ওটা ছিল আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম হতাশাজনক মুহূর্ত। শুধুমাত্র আমরা প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছিলাম বলে নয়, বরং আমরা তেমন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারিনি বলে। আমি কোনো গোলই করতে পারিনি, যা আমাকে আজও পীড়া দেয়। বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নেওয়াটা আমার এবং গোটা দলের জন্যই একটা ব্যর্থতা ছিল, যা চরম হতাশাজনক।

ফিফা: কাতার বিশ্বকাপে পোল্যান্ডের গ্রুপসঙ্গী আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো আর সৌদি আরব নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
লেভানডফস্কি: আর্জেন্টিনার বিষয়ে বেশি কিছু বলার নেই। আমার মতে, তারা টুর্নামেন্ট জেতার জন্য ফেবারিট দল। লিওনেল মেসির মতো কিংবদন্তির নেতৃত্বাধীন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচটি যে সবচেয়ে কঠিন হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত হাল না ছেড়ে মেক্সিকো লরাই করে যায়। তারুণ্য এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে তাদের দারুণ একটা দল আছে। বড় টুর্নামেন্টে মেক্সিকানরা কী করতে পারে, সেটি আমাদের মনে রাখতে হবে।
সৌদি আরব একটি সারপ্রাইজ প্যাকেজ। কঠিন রক্ষণভাগের পাশাপাশি তারা দারুণ কৌশলী। সেই খেলার বিরুদ্ধে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব, তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে।
আমি মনে করি আমরা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে গ্রুপপর্বে লড়বো। যদিও আমরা জানি যে লড়াইটি খুব কঠিন হবে, তবে আমরা আমাদের মুখে হাসি নিয়েই প্রতিটি ম্যাচে মাঠে নামব।