পারফরম্যান্স হোক আর পরিসংখ্যানের বিচারেই হোক, ফুটবল পণ্ডিত এবং বিশেষজ্ঞদের অনেকেই কিলিয়ান এমবাপ্পেকে ফিফা বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে আখ্যায়িত করছে। পণ্ডিতদের এই রায়ের ভিত্তিতে ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফিফা বিশ্বকাপ ইতিহাসের চারজন কিংবদন্তির সঙ্গে এমবাপ্পের পারফরম্যান্সের তুলনা করেছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক সেই চার কিংবদন্তির তুলনায় এমবাপ্পের অবস্থান কোথায়-
পেলে এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে
কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং ফুটবলের রাজা খ্যাত পেলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর দৃঢ় বন্ধনের কথা কারও অজানা থাকার কথা না। ফুটবলর ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি আছে শুধুমাত্র কালো মানিক পেলেরই। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির সেই কীর্তি ছুঁতে হলে অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে এমবাপ্পেকে দুর্দান্ত আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার দাঁড় করাতে হবে।
১৯৫৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ঝলক দেখিয়ে ব্রাজিলকে প্রথম বিশ্বকাপ জেতাতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন পেলে। সুইডেনে অনুষ্ঠেয় সেই আসরে মাত্র ১৬ দিনের ব্যবধানে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা, সর্বকনিষ্ঠ হ্যাটট্রিক এবং ফাইনালে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড রেকর্ডও গড়েছিলেন পেলে। ১৯৬২ সালের চিলি বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শিরোপাজয়ী দলের অংশ থাকলেও চোটের কারণে পেলের অবদান ছিল যৎসামান্য। তবে ১৯৭০ সালে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপে ঠিকই আবার মাঠে নিজের প্রতিভা আর সামর্থ্যের ছাপ রেখে সেলেসাওদের তৃতীয় শিরোপা এনে দিয়েছিলেন।

১৯৫৮ এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলের পক্ষে গোল করেছিলেন পেলে। ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান (১৯৯৮, ২০০৬), পশ্চিম জার্মানির পল ব্রাইটনার (১৯৭৪, ১৯৮২) এবং স্বদেশী ভাভা (১৯৫৮,১৯৬২) ছাড়া ফিফা বিশ্বকাপের দুটি ভিন্ন আসরের ফাইনালে গোল করার কীর্তি আছে কেবল পেলেরই। ফিফা বিশ্বকাপের চারটি আসরে ১৪টি ম্যাচ খেলে ১২ বার গোলের দেখা পেয়েছিলেন পেলে।
পেলের তিন বিশ্বকাপ জয়ের সেই অবিস্মরণীয় কীর্তি স্পর্শ কিংবা তার মতো আলোক ঝলমলে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার কিলিয়ান এমবাপ্পে গড়তে পারবেন কি-না, সেটি জানতে এখনও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে ফরাসি এই ফরোয়ার্ডের সামনে বিশ্বকাপ ফুটবলে পেলের গোলসংখ্যা ছাড়িয়ে যাওয়ার খুব ভালো সম্ভাবনাই রয়েছে। তবে পেলের মতো কিংবদন্তির কীর্তিগাথা ছুঁতে দুর্দান্ত কিছু সতীর্থ এবং একটু ভাগ্যের সহায়তাও প্রয়োজন হবে এমবাপ্পের।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে
কাতার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৭ মিনিটের ব্যবধানে দুবার জালে বল জড়ানোর মাধ্যমে টুর্নামেন্টে সব মিলিয়ে ৯টি গোল করে ফেলেছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। এর মাধ্যমে ফরাসি উইঙ্গার টপকে গেছেন বিশ্বকাপজয়ী প্রয়াত আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার গোলসংখ্যাকেও।
পেশাদার ক্যারিয়ারে চারবার ফিফা বিশ্বকাপের মঞ্চে (১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০ ও ১৯৯৪) উপস্থিত হয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। বিশ্বকাপের ওই চার আসরে আর্জেন্টিনার জার্সিতে ২১ ম্যাচ খেলে মোট ৮ গোল করেছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। তবে সেটি টপকে যেতে কিলিয়ান এমবাপ্পের প্রয়োজন হয়েছে মাত্র ১১টি ম্যাচ।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে দুজনই জাতীয় দলের হয়ে একবার বিশ্বকাপ শিরোপার স্বাদ পেয়েছেন। যদিও এমবাপ্পের চেয়ে একবার বেশি ফাইনাল খেলেছেন ম্যারাডোনা। আর্জন্টিনার জার্সিতে মহাকাব্যিক কীর্তি গড়ে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের চার বছর পর আরও একবার সোনালি ট্রফি থেকে হাতছোঁয়া দূরত্বে ছিলেন ম্যারাডোনা। যদিও পশ্চিম জার্মানির কাছে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

নিজে ৯টি গোল করার পাশাপাশি বিশ্বকাপে সতীর্থদের দিয়ে টুর্নামেন্ট রেকর্ড ৮টি গোল করিয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তবে সংখ্যা দিয়ে বিশ্বকাপের ম্যারাডোনাকে বোঝানো অসম্ভব। বিশেষ করে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা যেভাবে একক দক্ষতায় দেশকে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় আজও অম্লান। কাতার বিশ্বকাপে ফ্রান্সের জার্সিতে এমবাপ্পে সেরকম কোনো কীর্তি গড়তে পারবেন কি-না, তা সময়ই বলে দেবে।
রোনালদো নাজারিও ডি লিমা এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে
রোনালদো নাজারিও ডি লিমা এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে দুজনই ফরোয়ার্ড হলেও মাঠের খেলায় তাদের ভূমিকা ছিল ভিন্ন। তবে প্রসঙ্গ যখন বড় মঞ্চে জ্বলে ওঠার, তখন এমবাপ্পে এবং রোনালদো দুজনের সামর্থ্য যেন একই সুতোয় গাঁথা। ক্যারিয়ারে তিনবার বিশ্বকাপের মঞ্চে উপস্থিত হয়ে টুর্নামেন্টের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ গোল করেছেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি। সংখ্যাটা অনেক ফরোয়ার্ডের জন্য দূরের বাতিঘর হলেও এমবাপ্পে সেটিকে হাতের নাগালে নিয়ে এসেছেন।
ব্রাজিলের হয়ে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই সোনালি ট্রফি উঁচিয়ে ধরার স্বাদ পেয়েছিলেন রোনালদো। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় সেই আসরের সেলেসাওদের হয়ে এক মিনিটও মাঠে ছিলেন না ফেনোমেনোন। অন্যদিকে, ২০১৮ সালে ফ্রান্সের জার্সিতে বিশ্বকাপ জেতার সময়ে কিলিয়ান এমবাপ্পের বয়স ছিল মাত্র ১৯। তবে শুধু শিরোপা জয়ী দলের সদস্য হিসেবে না, চার গোল করে ফরাসিদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতাতে সরাসরি অবদানই রেখেছিলেন এমবাপ্পে।

তবে এমবাপ্পের দেশ ফ্রান্সে আয়োজিত পরের বিশ্বকাপে রোনালদো শুধু মাঠেই থাকেননি, বরং পায়ের কারুকার্যে বিশ্বকে বিমোহিত করেছিলেন। নামের পাশে চার গোল নিয়ে ব্রাজিলকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে তুলেছিলেন কিংবদন্তি স্ট্রাইকার। যদিও ফাইনালের আগের রহস্যময় অসুস্থতার কারণে মাঠে অনুজ্বল থাকায় শিরোপা জিততে ব্যর্থ হন রোনালদো। যদিও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোন্ডেন গিয়েছিল তার ঝুলিতেই।
সমসাময়িক বয়সের তুলনা করলে (২৩ বছর ১১ মাস) রোনালদোকে ইতোমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছেন এমবাপ্পে। তবে সার্বিকভাবে বিশ্বকাপে ফেনোমেননের প্রভাবকে টপকাতে এখনও অনেক দূর যেতে হবে এমবাপ্পেকে। নামের পাশে আরও ৬টি গোল তো অবশ্যই যোগ করতে হবে; সেই সঙ্গে ফাইনালে করতে হবে জোড়া গোলও, যেমনটা রোনালদো করেছিলেন ২০০২ বিশ্বকাপে। এছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে গোল্ডেন বল আর গোল্ডেন বুট পাওয়ার পাশাপাশি দলকে জেতাতে হবে আরেকটি বিশ্বকাপও।
মিরোস্লাভ ক্লোসা এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে
২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপে ২৩ বছর বয়সে জাঁতীয় দলের হয়ে প্রথমবারের মতো ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে আবির্ভাব হয়েছিল মিরোস্লাভ ক্লোসার। জার্মান এই কিংবদন্তির বিশ্বকাপ অভিষেকটাও হয়েছিলে দুর্দান্তরকম মনে রাখার মতো, প্রথম ম্যাচেই যে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে করেছিলেন হ্যাটট্রিক।
স্মরণীয় সেই বিশ্বকাপ অভিষেকের এক যুগ পর মিরোস্লাভ ক্লোসা যখন শেষবারের মতো বিশ্বকাপ খেলে বুটজোড়া তুলে রাখছেন, তখন তিনি টুর্নামেন্ট ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। জার্মানির হয়ে চারবার ফিফা বিশ্বকাপ খেলে নামের পাশে ১৬ গোল টুর্নামেন্ট ইতিহাসে ক্লোসা এখনও সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে থাকলেও এমবাপ্পে যে গতিতে এগোচ্ছেন, তাতে কিংবদন্তি জার্মান স্ট্রাইকারের কীর্তি নিশ্চিতভাবেই হুমকির সম্মুখীন।

ক্লোসা যে বয়সে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে প্রথমবার মাঠে নেমেছিলেন, সেই বয়সে এমবাপ্পে ইতোমধ্যেই একবার শিরোপা জিতে এবং ৯ গোল করে টুর্নামেন্ট ইতিহাসের সেরা পারফর্মারদের ছোট তালিকায় চলে এসেছেন। এছাড়া, ম্যাচপ্রতি গোলের হিসাবেও ক্লোসার (০.৬৭) চেয়ে এগিয়ে আছেন এমবাপ্পে (০.৮১)।
ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতোই জাতীয় দলের হয়ে দুবার ফাইনাল খেলে একবার শিরোপা জয় এবং একবার হারের স্বাদ পেয়েছেন মিরোস্লাভ ক্লোসা। ক্যারিয়ারের চারবারে বিশ্বকাপ খেলে প্রতিবারই দলের হয়ে কমপক্ষে সেমিফাইনাল খেলেছেন কিংবদন্তি জার্মান স্ট্রাইকার। এমবাপ্পের পক্ষে সেই রেকর্ড ছোঁয়া কিছুটা কঠিনই হবে বটে।