যুক্তরাজ্যে আয়োজিত ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের কাছে হেরেই শিরোপার নিঃশ্বাস ছোঁয়া দূরত্ব থেকে ফিরে এসেছিল নিউজিল্যান্ড। চার বছর বাদে পরবর্তী বিশ্বকাপেই প্রতিশোধের সুযোগ পেয়ে গেছিল ব্ল্যাক ক্যাপসরা, সেটিও বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই। শেষ পর্যন্ত ইংলিশদের বিপক্ষে কিউইদের প্রতিশোধটা এসেছে নির্মমভাবেই।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় গত দুই আসরের রানার্সআপ নিউজিল্যান্ড। প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৮২ রান সংগ্রহ করে ইংলিশরা। জবাবে ডেভন কনওয়ে ও রাচিন রাভিন্দ্রের বিধ্বংসী সেঞ্চুরিতে ৮২ বল হাতে রেখেই ৯ উইকেটের জয় তুলে নিয়েছে কিউইরা।
গত আসরের ফাইনালে নির্ধারিত ৫০ ওভার এবং সুপার ওভার শেষে ম্যাচ টাই হলেও বাউন্ডারির হিসাবে কপাল পুড়েছিল নিউজিল্যান্ডের। পরের বিশ্বকাপেই উদ্বোধনী ম্যাচে ইংল্যান্ডকে সামনে পেয়ে যেন চার বছর আগের সেই পুরোনো ঝাল ঝাড়লেন নিউজিল্যান্ডের দুই ব্যাটার।
নিউজল্যান্ডের পুরো ইনিংসে শুধু জায়গায় দাঁড়িয়েই এসেছে ১৬৮ রান। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে পঞ্চম সেঞ্চুরি করা কনওয়ে ১৯ চার ও তিন ছক্কায় ১২১ বলে ১৫২ রানে অপরাজিত ছিলেন। অন্যদিকে, ১১ বাউন্ডারি ও পাঁচ ছক্কার মাধ্যমে ওয়ানডেতে প্রথম শতক হাঁকানো রাভিন্দ্র ৯৬ বলে অপরাজিত ছিলেন ১২৩ রানে।
নিউজিল্যান্ডের এবারের বিশ্বকাপের জার্সিটা ১৯৯৬ বিশ্বকাপের আদলে তৈরি। ১৯৯৬ সালের আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল নিউজিল্যান্ড। এবারের মতো সেই বিশ্বকাপের আসরও বসেছিল উপমহাদেশের মাটিতেই। সেবারও থ্রি লায়ন্সদের বিপক্ষে জয়ের হাসি হেসেছিল নিউজিল্যান্ডই। এবারও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে যেন ২৭ বছর আগের সেই সুখস্মৃতিই ফিরিয়ে আনলো ব্ল্যাক ক্যাপসরা।
ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ২৮৩ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে নিউজিল্যান্ডের শুরুটা অবশ্য ভালো হয়নি। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই দলীয় ১০ রানে উইল ইয়াংকে হারায় কিউইরা। স্যাম কুরানের সুইঙ্গিং ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে ইংলিশ অধিনায়ক জস বাটলারের গ্লাভসে ধরা পড়েন ইয়াং। আউট হওয়ার আগে কোনো রান করতে পারেননি এ ডানহাতি ব্যাটার।
এরপর যা হলো, তাকে অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ইংল্যান্ডের বোলারদের কাছে সেটি দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। রাচিন রাবিন্দ্র ও আরেক ওপেনার ডেভিড কনওয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করলেন ইংলিশ বোলারদের নিয়ে। দ্বিতীয় উইকেটে দুজন মিলে অবিচ্ছিন্ন ২৭৩ রানের জুটি গড়ে নিউজিল্যান্ডকে জয়ের বন্দরে ভিড়িয়ে তবেই ক্ষান্তি দিয়েছেন।
এর আগে, টস হেরে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ডের পক্ষে ওপেনিংয়ে ছিলেন জনি বেয়ারস্টো ও ডেভিড মালান। ট্রেন্ট বোল্টের করা প্রথম ওভারের ও ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই ছক্কা মেরে দলের রানের খাতা খোলেন বেয়ারস্টো। ইংল্যান্ডের রানের চাকা সচল রাখতে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ছিলেন এ ডানহাতি ব্যাটার। পক্ষান্তরে, নিউজিল্যান্ডের বোলারদের বিপক্ষে সংগ্রামই করতে হয়েছে আরেক ওপেনার মালানকে।
এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম উইকেটের মালিক ম্যাট হেনরি। ইনিংসের অষ্টম ওভারের প্রথম বলে এ কিউই পেসারের বলে উইকেটের পেছনে টম ল্যাথামকে ক্যাচ দেন মালান। আউট হওয়ার আগে ২৪ বলে দুই চারে ১৪ রান করেন তিনি। ইনিংসের ত্রয়োদশ ওভারে ফিরে যান আরেক ওপেনার বেয়ারস্টো। মিচেল সান্টনারের বলে ড্যারিল মিচেলের হাতে ক্যাচ তুলে দেন ৩৫ বলে চার বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ৩৩ রান করেন তিনি।
জন্মভূমি নিউজিল্যান্ডকে কাঁদিয়ে গত বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডের জয়ের নায়ক হয়েছিলেন বেন স্টোকস। তবে ব্ল্যাক ক্যাপসদের বিপক্ষে এ ম্যাচে মাঠে নামেননি এ অলরাউন্ডার। স্টোকসের অনুপস্থিতিতে একাদশে জায়গা পান হ্যারি ব্রুক। মারমুখীভাবে শুরু করলেও নিজের ইনিংসটা লম্বা করতে পারেননি ২৪ বছর বয়সী ইংলিশ ব্যাটার। ১৭তম ওভারে আক্রমণে এসেই টানা তিন বলে ১৪ রান হজমের পর তাকে থামান রাচিন রবীন্দ্র। তার আগে মাত্র ১৬ বলে চার বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ২৫ রান করেন ব্রুক।
নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারালেও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং বন্ধ করেনি ইংল্যান্ড। ৯৪ রানে তৃতীয় উইকেট পতনের পরও ইংলিশদের দ্রুতগতিতে রান তোলা অব্যাহত রেখেছিলেন মঈন আলী। কিন্তু ২২তম ওভারে বিদায় নেন তিনিও। গ্লেন ফিলিপসের ঘুর্ণিতে বোল্ড হওয়ার আগে ১৭ বলে এক চারে ১১ রান করেন এ ব্যাটিং অলরাউন্ডার। ১১৮ রানে চার উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড তখন চাপের মুখে।
সতীর্থদের আসা-যাওয়ার মিছিলের সাক্ষী হওয়া জো রুট এবং অধিনায়ক জস বাটলার মিলে ইংল্যান্ডকে বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। পঞ্চম উইকেটে দুজন মিলে যোগ করেন ৭০ রান। ৩৪তম ওভারে তাদের জমে যাওয়া এ জুটি ভাঙেন হেনরি। ডানহাতি এ কিউই পেসারের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন ৪২ বলে দুটি করে চার-ছক্কায় ৪২ রান করা বাটলার।
বাটলারের বিদায়ের পর দলের সর্বশেষ স্বীকৃত ব্যাটার হিসেবে ২২ গজে এসেছিলেন লিয়াম লিভিংস্টোন। দারুণ সাবলীল ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে শুরুতে ভালো কিছুরও আভাস দিয়েছিলেন এ ডানহাতি ব্যাটার। কিন্তু তিনিও ইনিংস লম্বা করতে ব্যর্থ হন। নিউজিল্যান্ডের বর্ষীয়ান পেসার বোল্টের বলে হেনরির হাতে ধরা পড়ে ফিরে যান লিভিংস্টোন। আউট হওয়ার আগে ২২ বলে তিন বাউন্ডারিতে তিনি ২০ রান করেন।
উইকেটে সতীর্থদের থিতু না হতে পারার দীর্ঘ ব্যর্থতায় একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন রুট। সতীর্থদের আসা-যাওয়ার মিছিলে এক প্রান্ত আগলে রেখে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩৭তম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন তিনি। লিভিংস্টোনের বিদায়ের পর রুটও আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ফিলিপসের করা ৪২তম ওভারের প্রথম বলে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোল্ড হন এ ডানহাতি ব্যাটার। প্যাভিলিয়নের পথ ধরার আগে ৮৬ বলে চার বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ৭৭ রানের দায়িত্বশীল এক ইনিংস খেলেন রুট।
রুটের উইকেট তুলে নেওয়ার পর ইংল্যান্ডের ইনিংসের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে যায়। অষ্টম উইকেটে কারান-ওকসের ২১ আর দশম উইকেটে আদিল রশিদ-মার্ক উডের ২ জুটিতে ভর করে অবশ্য লড়াইয়ের ভালো পুঁজি পেয়ে যায় বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। স্যাম কারান (১৪), ক্রিস ওকস (১১), আদিল রশিদ (১৫) ও মার্ক উডের (১৩) ছোট ছোট অবদানের পর স্কোরবোর্ডে ২৮২ রান জমা করে ইংল্যান্ড। কিউইদের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩টি উইকেট নেন হেনরি। এছাড়া, সান্টনার ও ফিলিপস দুইটি করে উইকেট শিকার করেন।