খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে উপাচার্য ড. শহীদুর রহমান খানের স্বজনপ্রীতির তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপসারণের দাবী জানিয়েছে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি।
রবিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান এবং মহাসচিব শেখ মোহাম্মাদ আলী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এসব দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শহীদুর রহমান খানের অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির চিত্র উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে। এতে দেখা যায়, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক–শ্যালিকার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকেও অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই তা আটকে যায়। সব মিলিয়ে উপাচার্য নিজের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে নয়জনকে নিয়োগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।
উল্লেখ্য, উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের পাঁচজন সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। গঠনের এক বছরের বেশি সময় পর ২৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপাচার্য শহীদুর রহমান খান নিজের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে কমপক্ষে ৯ জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্য নিজের ছেলে শফিউর রহমান খান ও শ্যালক জসীম উদ্দিনকে নিয়োগ দিয়েছেন শাখা কর্মকর্তা পদে। চারজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা উপাচার্যের ভাতিজা। এই ভাতিজারা হলেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে মুরাদ বিল্লাহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে সুলতান মাহমুদ, ল্যাব টেকনিশিয়ান পদে ইমরান হোসেন এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মিজানুর রহমান।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উপাচার্যের শ্যালিকার ছেলে সায়ফুল্লাহ হককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে। এছাড়া নিকটাত্মীয় নিজাম উদ্দিনকে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য। তাদের সবাইকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। মেয়ে ইসরাত খানকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটি ত্রুটিযুক্ত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কারণ, তিনি অন্য প্রার্থীর চেয়ে শিক্ষাজীবনের ফলে পিছিয়ে ছিলেন।
তদন্ত কমিটি বলেছে, উপাচার্যের মেয়েকে নিয়োগ প্রক্রিয়াতে স্বজনপ্রীতি ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে। নিজের স্ত্রীকেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। উপাচার্যের স্ত্রী ফেরদৌসি বেগম ছাতক উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। তবে এই নিয়োগ স্থগিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তদন্ত কমিটি বলছে, উপাচার্যের স্ত্রী নিয়োগের শর্তই পূরণ করেননি।
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, উপাচার্যের আত্মীয়স্বজনের বাইরে অর্থ-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা শিথিল করেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে উৎকোচের বিনিময়ে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে খুলনার স্থানীয় প্রার্থীদের কৌশলে বাদ দিয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, উপাচার্যের নিজ জেলা নোয়াখালী, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের নিজ জেলা নরসিংদী এবং উপাচার্যের স্ত্রীর নিজ জেলা বরিশালের লোকজনকে একচেটিয়া নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
২০১৫ সালের ৫ জুলাই জাতীয় সংসদে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খান। তিনি ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর রেজিস্ট্রার পদের বিপরীতে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে ছয় মাসের জন্য অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেন ডা. মো মাজহারুল আনোয়ারকে। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাতজন সহকারী অধ্যাপক, একজন সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং ১৪ জন প্রভাষকসহ ২৯ ধরনের পদের জন্য ৭৬ জন জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেই থেকেই অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ ও স্থানীয় প্রার্থীদের কৌশলে বাদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে কৌশলে একের পর এক বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে।
রেজিস্ট্রার সার্বজনীন পদ হলেও “কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর”-এর শর্ত আরোপ করা হয়, যা দেশের অন্য কোনো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। রেজিস্ট্রার মূলত প্রশাসনিক পদ। খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিজেই সেই পদের জন্য প্রার্থী হন।
ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাওয়া মো. আশিকুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা যোগ্যতার চেয়ে কম। তিনি ডিভিএমে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং এমএসসিতে প্রথম শ্রেণি পাওয়া।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল, প্রার্থীকে সিজিপিএ-৪ এর মধ্যে ন্যূনতম সাড়ে ৩ পেতে হবে। এই শর্ত শিথিল করা যাবে, যদি প্রার্থীর পিএইচডি ডিগ্রি থাকে। আশিকুল আলমের পিএইচডি ডিগ্রি ছিল না। জানা যায়, তিনি উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের অধীনে গবেষণারত ছিলেন।
নিয়োগে অনিয়ম ও ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে কয়েকবার ফোন করেও খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শহীদুর রহমান খানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ইউজিসির প্রতিবেদনে আশিকুল আলমের শিক্ষক হিসেবে পাওয়া নিয়োগটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া, স্ত্রীকে সরাসরি অধ্যাপক বানানোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করা এবং সব নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অঞ্চলপ্রীতি না করাসহ ৭ দফা সুপারিশ করা হয়।