রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে হোটেল বা রেস্টুরেন্টের অভাব নেই। বিভিন্ন অলিগলিতে গড়ে উঠছে অসংখ্য রেস্তোরাঁ। ক্রেতা ও ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে সেসব রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন খাবারের আকর্ষণীয় প্যাকেজেরও কোনো কমতি নেই। ডিসকাউন্ট বা অফারের কারণে সেসব প্যাকেজের প্রতি মানুষের আগ্রহও ব্যাপক।
তবে ঢাকায় এমনও একটি হোটেল আছে যেখানে খেতে গেলে আপনার পকেট থেকে কোনো টাকা খরচ হবে না। সেই হোটেলে এক বেলা খাবার খেতে গেলে আপনাকে দিনে শুধুমাত্র একটি ভালো কাজ করলেই চলবে।
তবে আপনি যদি দিনে কোনো ভালো কাজ নাও করে থাকেন, তাহলেও আপনার নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ দিনে কোনো ভালো কাজ করা ছাড়াও আপনাকে খালি মুখে সে হোটেল থেকে ফিরে আসতে হবে না। আপনি সেখানে খাবার পাবেন। তবে শর্ত একটাই- পরের দিন আপনাকে অবশ্যই দুইটি ভালো কাজ করতে হবে।

রাজধানীর ব্যতিক্রমী এ হোটেলটির নাম “ভালো কাজের হোটেল”। মূলত দিন আনা দিন খাওয়া দুস্থ, অসহায় ও শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা করতেই এ হোটেলের যাত্রা শুরু।
ক্ষুধার যন্ত্রণার কারণে সারা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই খারাপ পথ বেছে নেয়- এ বিশ্বাস থেকে, "ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ" নামের সংগঠন ভালো কাজের বিনিময়ে খাদ্য বিতরণের উদ্যোগ নেয়। ক্ষুধা ও অপরাধমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে দুঃস্থ মানুষের সেবা করে আসছে।
প্রতিদিন দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকার তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে শত শত মানুষ জড়ো হয় এবং স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের মধ্যে খাবার বিতরণ করে তারা। চেয়ার-টেবিলসহ অন্যান্য সুসজ্জিত ব্যবস্থা না থাকলেও খোলা আকাশের নিচে ফুটপাতে সারিবদ্ধ হয়ে বসে সবাই তৃপ্তি সহকারেই খাবার খেয়ে নেয়।

এ হোটেলে খেতে আসা মিরাজ জানান আগের দিন একজন বৃদ্ধকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করেছেন।
অপু নামের আরেক ব্যক্তি জানান, এ উদ্যোগের কথা শোনার পর থেকে তিনি প্রতিদিন অন্তত একটি ভালো কাজ করার চেষ্টা করেছেন।
হোটেলে খাবার খেতে আসা মানিক বলেন: "তারা আমাদের মতো লোকদের খাওয়ায় বলে আমরা সবাই তাদের জন্য মন থেকে দোয়া করি।"
ভালো কাজের হোটেলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আরিফুর রহমান এ উদ্যোগের পেছনে তার অনুপ্রেরণার কথা জানিয়ে ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “ছোটবেলায় আমি হুমায়ূন আহমেদের 'সবুজ ছায়া' নামের একটি নাটক দেখেছিলাম। সে নাটকে অভিনেতা জাহিদ হাসান প্রতিদিন অন্তত একটি ভালো কাজ করতেন। সেই ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি এবং আমার কিছু বন্ধু ২০০৯ সালে ভালো কাজের হোটেল চালু করি।”

এ হোটেলের সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক রুলেব আহমেদ হিমেল বলেন, “যারা খাবারের জন্য আমাদের কাছে আসে, তারা তাদের সেদিনের করা ভালো কাজের কথা জানিয়েই খাবার নেয়। কেউ কেউ অবশ্য কোনো কোনোদিন ভালো কাজের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেন না। তবে আমরা তাদেরকে খাবার থেকে বঞ্চিত করি না। খাবার দিয়ে তাদেরকে পরদিন দুটি ভালো কাজ করার উৎসাহ দিই।”
এমন একটি উদ্যোগের অংশ হতে পেরে নিজের গর্বের কথা জানিয়ে তিনি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, "সারা দিনের পরে, যখন আমাদের দেওয়া খাবার তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার পর মানুষের মুখে হাসি দেখি, তখন আমার মন খুশিতে ভরে যায়।”
মজিরুজ্জামান মনির নামের আরেক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, “নিজের ভালোলাগা থেকেই আমি এ কাজ করি। বাবুর্চিরা খাবার রান্না করার পর আমরা তা ভালো কাজের হোটেলে (বনানী, তেজগাঁও এবং কমলাপুর) পৌঁছে দিই।"
এ হোটেল পরিচালনার জন্য প্রায় দেড় হাজার সদস্য প্রতিদিন ১০ টাকা জমা দেন। এর মাধ্যমে প্রতি মাসে এ হোটেলের সাড়ে ৪ লাখ টাকার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া, অনেক শুভাকাঙ্খীরাও ভালো কাজের হোটেলের জন্য অর্থ অনুদান দিয়ে থাকেন।
সম্প্রতি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পুরাতন রেলস্টেশনে ভালো কাজের হোটেলের আরেকটি শাখা চালু হয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার সদস্য ওই শাখার সঙ্গে যুক্ত আছে। তারা প্রত্যেকে হোটেল পরিচালনার জন্য মাসে ৩০০ টাকা জমা করেন।
নিবন্ধনের মাধ্যমে সহজেই যে কেউ এই উদ্যোগের অংশ হতে পারে। এ উদ্যোগের রেজিস্ট্রেশন ফি ২০০ টাকা।
সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবা সংক্রান্ত তথ্যের জন্য যোগাযোগ নম্বর- ০১৭১৩২২২৩৪৩ এবং ০১৮৭৩৭০৮০০। সংগঠন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য ভালো কাজের খাবার ওয়েবসাইটে (https://vkhbd.org) পাওয়া যাবে। এছাড়া, সামাজিক যোগাযেগমাধ্যম ফেসবুকে তাদের অফিসিয়াল পেজ থেকেও বিভিন্ন তথ্য জানা যাবে।