চরম অনাদর, অবহেলা আর নিষ্পেষণে বড় হচ্ছে পথশিশুরা। ঢাকায় অন্তত ২২৯টি নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, যেখানে পথশিশুরা বেড়ে উঠছে কোনো যত্ন ছাড়াই।
ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার রাস্তায়, ট্রেন স্টেশনে, ফুটপাথে বা ফ্লাইওভারের কোনো একটু সামান্য জায়গায় রাতে ঘুমায় তারা। তাদের বস্ত্র মলিন, আচরণে উদাসীনতা এবং পুষ্টিহীনতায় ভোগে তারা। কেন তারা রাস্তায় ঘুমায়? তাদের কি ঘরবাড়ি আছে নাকি তারা বাড়ি ফিরতে চায় না?
পথশিশুদের সঙ্গে কথা বলে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ঢাকা ট্রিবিউন। কথা বলে জানা গেছে, এই পথশিশুদের অনেকের বাবা-মা নেই, অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।
স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আগ্রহ কারো কারো
ঢাকায় পথশিশুদের মধ্যে একজন মামুন; আট বছর বয়সে নরসিংদীর পলাশ থেকে ঢাকায় আসা তার। এখন বয়স ১৮ বছর। দশ বছর আগে বাবাকে হারিয়ে ঢাকায় আসতে বাধ্য হয়েছিল সে। তারা পাঁচ ভাই-বোন। তার মা আছিয়া খাতুন কাজ করেন পলাশ উপজেলার একটি ইটভাটায়।
ঢাকায় এসে পথশিশুদের সঙ্গে বোতল ও কাগজ কুড়ানোর কাজ শুরু করেছিল মামুন। এরপর আর বাড়ি ফেরার মতো অবস্থা ছিল না। এখন সে পরিবারের কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়।
গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মামুনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা ট্রিবিউনের। সে বলে, “আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই। আমাকে সেই সুযোগ করে দেওয়া হোক। এভাবে আর বাঁচতে চাই না। কোনো অপরাধ না করলেও মানুষ অপরাধী মনে করে, মারধর করে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরলে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাব।”
ঘরে ফেরার আগ্রহ নেই অনেকের
টঙ্গী স্টেশন কাজ করে মার্জিয়া (১৫); সৎ মায়ের অত্যাচার সইতে না পেরে পাঁচ বছরের ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল সে। স্টেশনেই রাত কাটে তাদের।
মার্জিয়া জানায়, খুব অল্প বয়সে সে তার মাকে হারিয়েছিল। ছোট সন্তানদের মানুষ করতে তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্তত নেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তই ঘরছাড়া করে তাদের। তার বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক মাস পর থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। তাকে আর তার ছোট ভাইকে প্রায় প্রতিদিনই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো।
এই নির্যাতন থেকে বাঁচতে তারা দুই ভাইবোন বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে টঙ্গী স্টেশনে আশ্রয় নেয়। তারা দুই ভাইবোন স্টেশনের বাথরুম পরিষ্কার ও স্টেশনের দোকানে টুকিটাকি কাজ করে খাবার জোগায়।
তারা আর কখনোই বাড়িতে ফেরার কথা ভাবে না। স্বজনহীন আর দেয়ালহীন স্টেশনেই তাদের কাছে নিরাপদ মনে হয়।
অপরাধে জড়াচ্ছে পথশিশুরা
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করা পথশিশুরা শুরুর দিকে বোতল আর কাগজ কুড়োনোর মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলেও ক্রমে তারা নানা অপরাধ কর্মে জড়াচ্ছে। চুরি, ট্রাক থেকে পণ্য ছিনতাইসহ নানা অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত হচ্ছে তারা।
পথশিশুদের সমস্যা নিয়ে কাজ করছে সরকার। এছাড়া পথশিশুদের আশ্রয়, খাবার ও শিক্ষা দিয়ে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা কাজ করছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-সচিব ও সামাজিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ড. মো. মোক্তার হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে সমস্যা হলো পথশিশুরা শৃঙ্খল মানতে চায় না। তারা পালিয়ে যায়। তারা রাস্তার স্বাধীনতায় আনন্দ খুঁজে পায়। তারা দীর্ঘ সময় ধরে নির্ধারিত নিয়মের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে না।”
তিনি বলেন, “প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। পথশিশুদের প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উপায়ে কাজ করছি।”
২০০৭ সাল থেকে পথশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতসহ নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী “পথশিশু সেবা সংগঠন”।
তাদের ভাষ্য, বেশির ভাগ কিশোর-কিশোরী পারিবারিক বিরোধ ও দারিদ্র্যের কারণে রাস্তার জীবন বেছে নিচ্ছে। সঠিক নির্দেশনার অভাবে তাদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে অপরাধের প্রতি তাদের ঝোঁক বেড়ে যায়। সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় পথশিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করে সংস্থাটি।