কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে জাপানিদের স্টেডিয়ামের ময়লা পরিষ্কার করার দৃশ্য দেখে বাঙালিরা তাদের প্রশংসা করছিলেন। সেসময় কথা উঠেছিল, পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ার। কিন্তু ওই চাওয়াটুকুতেই সীমাবদ্ধ আমরা।
সম্প্রতি টানা ভারি বৃষ্টিতে ঢাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনের দায় প্রধানত শহরের কর্তৃপক্ষের হলেও সেসময় যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলার বিষয়টি সামনে আসে। এসব বিষয় সামনে আসার প্রধান কারণ, আমরা মূলত ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন নগরী চাই।
এবার সেই চাওয়াকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করায় উদ্যোক্তা কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশুর নেতৃত্বে থাকা শতাধিক তরুণের একটি দল। ঢাকার মোহাম্মদপুর সোসাইটি লিমিটেড এলাকার একটি খাল থেকে কয়েক স্তরের ময়লা সরিয়েছে তারা। একদম পাল্টে গেছে খালের চিরচেনা রূপ।
সিটির স্থানীয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী, শতাধিক তরুণের সহায়তায় গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর এই দুই দিনে খাল এলাকার ১ থেকে ৪ নম্বর ব্রিজের পুরো অংশ পরিষ্কার করেন তারা। মোর্শেদ মিশুদের এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল “এশিয়ান পেইন্ট” ও “অ্যাওয়ারনেস থ্রি সিক্সটি”।
খাল পরিষ্কারের উদ্যোগের বিষয়ে মোর্শেদ মিশু অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “সম্প্রতি কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহর ডুবে গেল। তখন একটা ভিডিও ফেসবুকে নজরে এসেছিল। সেই ভিডিও দেখেই মনে হলো খাল পরিষ্কার করে ফেলতে পারলে কেমন হয়। কারা এর সঙ্গে যুক্ত হতে চান ফেসবুকে পোস্ট করে জানাতে চাওয়া হয়। প্রায় একশ জন তরুণ যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন।”
এরপর স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মিশু। কমিশনার এই টিমের সঙ্গে স্থানীয় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন। গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর দুই দিনে ১ থেকে ৪ নম্বর ব্রিজের পুরো অংশ পরিষ্কার করে দলটি।
এই খাল থেকে বাসার তোষক, কমোড, বসার পাটি, থেকে শুরু করে নিত্য-ব্যবহার্য সব ধরনের জিনিসপত্র ছিল। মিশু বলেন, “শুরুতে আমরা যখন ময়লা টানছিলাম তখন অনেক সময় লাগছিল। পরে সিটি কর্পোরেশন থেকে ডুবুরি এনে তারা ব্রিজের নিচের অংশে যেসব পাইপ আছে সেগুলো ফাঁকা করে ময়লা যাওয়ার রাস্তা করে দিলে কাজ একটু সহজ হয়।”
এই পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ৮৬,৫৩০ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা মোর্শেদ মিশু।
মানুষ সভ্য না হলে পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়
এই পরিচ্ছন্নতা অভিযানের শুরু থেকেই নানাভাবে যুক্ত ছিলেন স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার আসিফ আহমেদ সরকার। তিনি বলেন, “খাল পরিষ্কারের তিন দিনের মধ্যে খালে আবার ময়লা জমতে শুরু করেছে।”
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে আসিফ আহমেদ সরকার বলেন, “খালটি হাজারীবাগ থেকে শুরু হয়ে মোহম্মদপুরের ভেতর দিয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে বের হয়ে গেছে। এই পুরো এলাকায় কে কীভাবে ময়লা ফেলে তা মনিটরিং করা তো সম্ভব নয়। এখানে বাসার নষ্ট ফ্রিজ থেকে শুরু করে সব পাবেন।”
মানুষ সভ্য না হলে এর থেকে উত্তরণ নেই বলে মনে করেন এই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
তবে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মিশু মনে করেন, “মানুষ ময়লা ফেলবে, থামানো যাবে না। তবে নিয়মিত পরিষ্কার করলে খালে কয়েক স্তরের পুরু ময়লা আর জমবে না।”
দখলে-দূষণে মৃতপ্রায় ঢাকার জলাশয়-খাল
পরিবেশবিদরা বলছেন, একটি শহরে কমপক্ষে ১৫% প্রাকৃতিক জলাধার থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকায় বাস্তবে তা ৪-৫%-এরও কম। যে জলাশয়গুলো রয়েছে তার প্রায় অধিকাংশই দূষণ-দখলে মৃতপ্রায়। এ অবস্থায় ঢাকার পরিবেশ হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
মৎস্য বিভাগের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল ২,০০০টি। ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১০০টিতে, আর ২০২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২৯টিতে।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্যমতে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় খালের সংখ্যা ৪৭।
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় বর্তমানে মোট ৬৩টি খাল, ১৩টি লেক ও একটি আদি চ্যানেলের অস্তিত্ব রয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় মোট ৭৭টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকার জলাশয়গুলো বাঁচাতে না পারলে ভয়াবহ পরিবেশ ঝুঁকিতে পড়বে নগরবাসী। পুকুর-নদী-খালগুলোকে জীবন ফিরিয়ে দিতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, “কেবল পানির উৎসের জন্য নয়, ঢাকা শহরে বৃষ্টির সময় যে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় তা থেকে রক্ষার জন্য খাল, পুকুর ও জলাধারগুলো উদ্ধার প্রয়োজন। আর আমরা যদি ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভর করে বসে থাকি তাহলে চরম সংকটে পড়ব।”