প্রথমবারের মতো প্রবাস থেকে বাংলা নাটকের কোনো দল বাংলাদেশে মঞ্চস্থ করলো তাদের বাংলা নাটক। কানাডার দল টরন্টো থিয়েটার ফোকস ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চস্থ করে গেলো তাদের নতুন মঞ্চনাটক “এক জোড়া জুতা”।
পুরো নাটকে অভিনেতারা প্রতীক্ষায় ছিলেন কখন তারা খুঁজে পাবেন হারানো এক জোড়া জুতা। নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে নাটকের চরিত্ররা স্বজন হারানো ব্যথার নানান ব্যঞ্জনাও উপস্থাপন করেছেন নাটকে। নাটকের শেষ দৃশ্যে ইমরুল খুঁজে পায় সেই জুতা জোড়া যা ছিল তার কাছে আত্মনির্ভরতার, সাহসের, আর ভালোবাসার প্রতীক।
বাংলাদেশে এই নাটকের শেষ প্রদর্শিনীতে দর্শকসারিতে উপস্থিত থেকে নাটকটি দেখেছেন বেশ ক’জন নাট্যপ্রেমী, নাট্যব্যক্তিত্ব। নাটক শেষে নাট্যকার ও উপন্যাসিক মাসুম রেজা উপস্থাপনার প্রশংসা করে বলেন, "টরন্টো থিয়েটার ফোকস এর এই সাহসী প্রযোজনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা নাটকচর্চা ও প্রবাসী নাট্য শিল্পীদের বিশেষভাবে উজ্জীবিত করবে বলে আশা রাখি। সুরিয়ালিস্টিক এবসার্ড আঙ্গিকে হারানো এক জোড়া জুতা খোঁজার মধ্য দিয়ে তারা নান্দনিক উপস্থাপনায় সত্য ও সুন্দরকে খুঁজেছেন। কলাকুশোলিদের ধন্যবাদ"।
প্রবাসে বাংলা নাট্যচর্চায় টরন্টো থিয়েটার ফোকসের ভূমিকার কথা বলতে যেয়ে তিনি আরও বলেন , “টরন্টো থিয়েটার ফোকসের নাট্যচর্চার কার্যক্রমের দৃষ্টান্তে বাংলাদেশের বাইরের অন্যান্য দেশের নাট্যকর্মীদের ভেতরেও বাংলা নাট্যচর্চাকে বেগবান করবার তাগিদ জোরদার হয়েছে।”
মেহরাব রহমানের রচনায় ইমামুল হকের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এই নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয় কানাডার টরন্টো শহরে। নির্দেশক ইমামুল হক বলেন, “টরন্টো শহরে এই নাটক দর্শকদের মন জয় করেছে এবং বাংলা নাটকের জন্যে প্রবাসে নতুন দর্শক তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। নাটকের কুশীলবরা মঞ্চজুড়ে নিখোঁজ হওয়া এক জোড়া জুতা খোঁজার মধ্য দিয়ে তাদের হারানো আত্মবিশ্বাস খুঁজেছেন, হৃদয় গভীরে জমে থাকা ব্যথাকে অনুভব করেছেন।”
এবার ঢাকার মঞ্চে বাংলাদেশের প্রাচ্যনাটের সঙ্গে যৌথ উপস্থাপনায় এই নাটক এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।”
নির্দেশক জানান, "অল্প সময়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রাচ্যনাটের শিল্পীদের সঙ্গে ঢাকার মঞ্চে এই নাটকের উপস্থাপন আমাদের জন্যে এক নতুন ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সামনে বাংলা নাটক নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো কাজের আগ্রহ তৈরী হয়েছে আমাদের।" ৮০ দশকে জনপ্রিয় হাসির নাটক “কঞ্জুস”এর মূল চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে ইমামুল হক (কিসলু) নাট্য জগতে বিশেষ ভাবে পরিচিত ছিলেন।
ঢাকার মঞ্চে “এক জোড়া জুতা” নাটক মঞ্চায়নের পুরো প্রক্রিয়া ও ব্যাবস্থাপনার সমন্বয় করেন প্রাচ্যনাট্যের অন্যতম সদস্য শক্তিশালী অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ। নাটক দেখে নাট্যশিক্ষক, অভিনেত্রী ও নির্দেশক নায়লা আজাদ নুপুর বলেন,“প্রাচ্যনাটের তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে টরন্টো প্রবাসী টরন্টো থিয়েটার ফোকস এর শিল্পীদের সমন্বয় ও মঞ্চ ব্যবহার ভালো লেগেছে। গল্প উপস্থাপনায় কখনো কখনো রূপকের ব্যবহার অতিরিক্ত হলেও নাটক শেষে নাটকের মূল ভাবনা দর্শকদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি।” নাটক মঞ্চায়নের এই আদানপ্রদান ও যৌথ প্রয়াসকে তিনি স্বাগত জানান।
দুই দেশের নাট্যদলের এই যৌথ প্রয়াসের কথা বলতে যেয়ে নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম বলেন, “এমন যৌথ কাজের সুযোগ দুই দলের জন্যেই এক নতুন অভিজ্ঞতা। আগামীতে টরন্টো থিয়েটার ফোকসের যে কোনো ধরণের নাটকের পরীক্ষা নিরীক্ষায় টরন্টো থিয়েটার ফোকস এর পাশে থাকবে প্রাচ্যনাট। ভালো নাটকের কাজের জন্যেই আমাদের এমন আদান প্রদানের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করতে হবে।” এই যৌথ প্রয়াসের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন আজাদ আবুল কালাম।
বাংলাদেশের এই নাটকের দুটি মঞ্চায়নে কানাডা থেকে আগত শিল্পী অরুণা হায়দার, নয়ন হাফিজ, মেহরাব রহমান ও ইমামুল হক ছাড়াও প্রাচ্যনাটের সাবরিনা রহমান, অদ্রি জা আমিন, সারাহ জেবিন অদিতি, ফাহমিদা আক্তার আঁখি, স্বাতী ভদ্র, ডায়না ম্যারোলিন চৌধুরী, আরিফুল রুবেল অভিনয় করেন। স্নাতা শাহরিনের পরিকল্পনায় নাটকে বিভিন্ন চরিত্রের আবেগ আর অনুভূতির কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে নান্দনিক প্রকাশ ছিল লক্ষণীয়। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে মেহরাব রহমান, অরুণা হায়দার, ইমামুল হক ও নয়ন হাফিজ ভালো করেছেন, তাদের অভিনয়ে পরিশ্রমের ছাপ ছিল। নাটক জুড়ে প্রায়ই দর্শকদের চোখ ভিজে যাচ্ছিলো বিশেষ করে বড়ভাই’র (দাদা’র) জন্যে ইমরুলের গভীর আকুতি দেখে।
বিশ্বায়নের প্রভাব আর নিজস্ব স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠায় অভিবাসী মানুষ প্রবাসেও নানান প্রতিকূলতায় সংস্কৃতি চর্চা করে, বাংলা নাটক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। কানাডায় বাংলা নাটকের ইতিহাস, নাট্যচর্চা, প্রতিকূলতা আর সম্ভাবনার নানান কথা ও কাহিনীও তারা বলে গেলেন শিল্পকলার সেমিনার কক্ষে ফেব্রুয়ারী ২০ তারিখ “কানাডায় বাংলা নাটক চর্চা” শীর্ষক এক আলোচনায়।
টরন্টো থিয়েটার ফোকস আর প্রাচ্যনাটের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে আলোচকরা বলেন, “সংস্কৃতি চর্চায় আন্তঃদেশীয় আদান প্রদানের মাধ্যমে কার্যকর পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ তৈরী হবে যা বাংলানাটকের চর্চাকে বেগবান করবে। বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের সঙ্গে প্রবাসে বাংলা নাটকের শিল্পীদের সঙ্গে একটা নিয়মিত যৌথ কাজের সুযোগ তৈরী করতে হবে এবং তরুণ ও পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলানাট্য চর্চায় উৎসাহ ও উজ্জীবিত করতে সেমিনারের অংশগ্রহণকারীরা সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহব্বান জানান। সেমিনারে পারভেজ চৌধুরীর প্রবন্ধের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেন নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম, নাট্যকার অভিনেতা মেহরাব রহমান, অভিনেতা নির্দেশক ইমামুল হক ও নাট্যশিক্ষক, অভিনেত্রী ও নির্দেশক নায়লা আজাদ নুপুর। নাটক মঞ্চায়ন ও নাটক নিয়ে কথা বলার দুই দেশের এমন যৌথ উদ্যোগকে ঢাকার দর্শকরা স্বাগত জানিয়েছেন।