Friday, April 18, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

একা মায়ের সন্তানদের মনোজগত কেমন হয়

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১.২০% বিবাহিত নারী স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, দ্বিতীয় বিয়ে ও শারীরিক নির্যাতন, ৩৪.৬০% বিবাহবিচ্ছেদ এবং ৪৪.২% স্বামীর মৃত্যুর কারণে একাই সন্তানদের বড় করছেন

আপডেট : ৩০ মে ২০২৩, ০৭:৩২ পিএম

শিশুর মনোজগত এক পরম বিস্ময়। তাদের কৌতূহলী মন চারপাশের সব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করে। আর এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার গুরুদায়িত্ব বর্তায় বাবা-মায়ের ওপর। এভাবেই শিশুর মানসিক বিকাশ হয়। কোনোভাবে শৈশবের শুরুতেই বাবা-মায়ের যেকোনো একজন কাছে না থাকার বিষয়টি শিশুর জগতকে এলোমেলো করে দেয়। এছাড়া, বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় যেসব নারী একাকি অর্থাৎ পুরুষ সঙ্গীর অনুপস্থিতিতে সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব নেন তাদের করতে হয় একরকম যুদ্ধ।

“ডিপ্রেসিভ অ্যান্ড অ্যাঞ্জাইটি ডিসর্ডার অ্যামং সিঙ্গেল মাদার্স ইন ঢাকা সিটি” শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব নারীরা পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই সন্তানের দায়িত্ব নেন (সিঙ্গেল মাদার বা একা মা) তাদের ৫৪%-এরও বেশি বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। যার মধ্যে রয়েছে- কাজের চাপ, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং আর্থিক চাপ।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১.২০% বিবাহিত নারী স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, দ্বিতীয় বিয়ে ও শারীরিক নির্যাতন, ৩৪.৬০% বিবাহবিচ্ছেদ এবং ৪৪.২% স্বামীর মৃত্যুর কারণে একাই সন্তানদের বড় করছেন। এসব একা মায়েদের মধ্যে ১৭.৩% গৃহকর্মীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

এই নারীদের প্রচণ্ড মানসিক চাপের মুখোমুখি হয় প্রতিনিয়ত। মায়ের মানসিক চাপ তাদের সন্তানের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলে, এসব শিশুরাও কি আলাদা করে চাপের মুখোমুখি হয়? এসব বিষয় জানার চেষ্টা করেছে ঢাকা ট্রিবিউন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ শাখা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক যৌথ জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের ১৩.৬% মানসিক রোগে ভুগছে। মানসিক রোগকে ট্যাবু মনে করায় অনেক শিশুরই চিকিৎসা হয় না।

৩৫ বছর বয়সী আমেনা (ছদ্মনাম) একাই মানুষ করছেন ছেলে আমিনকে (১৬)। সন্তান জন্মের পরপরই আমিনের বাবা উধাও হয়ে যান। অসহায় এই নারী তখন শিশু সন্তানকে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছে রেখে ঢাকায় চলে আসেন। নেন গৃহকর্মীর কাজ।

এদিকে, বুঝতে শেখার পর বাবার অনুপস্থিতি ভাবাত ছেলে আমিনকে। আমেনা বলেন, “ছেলের ছোটবেলা তার বাবা আমাদের ফেলে চলে গেছে। মনে হয় অন্য জায়গায় বিয়া-টিয়া করছে।”

ছেলের মানসিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ছেলের আর কি মানসিক সমস্যা হইব, তবে সে অনেক জিদ করে। আমি বলছিলাম লেখাপড়া করতে। সে লেখাপড়া ছাইড়া চাকরিতে ঢুকে গেছে। আমার কথা শুনতে চায় না। এতো কষ্ট কইরা মানুষ করলাম এখন কথা শোনে না।”

ইউনিসেফের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের প্রতি সাতজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের ৫%-এর মধ্যে আত্মহত্যা এবং উদ্বেগ প্রবণতা রয়েছে।

মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা সহায়তার প্ল্যাটফর্ম “মনের বন্ধু”র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তাওহিদা শিরোপা ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আলাদা থাকা বাবা-মায়ের মাঝে আজকাল কো-প্যারেন্টিংয়ের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। এটি সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই সহায়ক। তবে নিম্নবিত্তের মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা। তাদের মধ্যে এ বিষয়টি তেমন দেখা যায় না। তবে বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা খুবই জরুরি। তারাও আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

একইরকম পরিস্থিতির মধ্যে সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন গৃহকর্মী সুফিয়া (ছদ্মনাম)। ৯ বছর আগে তার স্বামী ৯ মারা গেছেন। এক ছেলে আর এক মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে রেখে ঢাকায় িএসে নিয়েছেন গৃহকর্মীর কাজ।

তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা ট্রিবিউনের। তিনি বলেন, “আমার ছেলে-মেয়েরে গ্রামের বাড়ি রেখে আসছি। ঢাকা শহরে এনে তাদের নিয়ে খরচ কুলাতে পারি না। গ্রামের বাড়িতে ওরা নানা-নানির কাছে নিশ্চিন্তে আছে। আমাকেও চিন্তা করতে হয় না।”

তার ১২ বছর বয়সী মেয়ে আয়েশার ভাষ্য, “আমার বাবা নাই। মা আমাদের অনেক কষ্ট করে মানুষ করছে। বাবা থাকলে আমাদের এতো কষ্ট হতো না।”

কষ্টের দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে সুফিয়া বলেন, “বাচ্চাদের একা মানুষ করতে অনেক কষ্ট হইছে। স্বামী বেঁচে থাকতে আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম না। পোলাপানের বেশি কষ্ট হইসে কারণ বাবা হইসে বটগাছের ছায়া। তাদের মন বেশি খারাপ হয়। আমার ছেলে মাঝে-মধ্যে মন খারাপ করে। এখন কী করুম? কাম কইরা তো খাইতে হবে। এ জন্য ওদের রাইখা আসছি।”

“ডিপ্রেসিভ সিম্পটম্পস অ্যামং অ্যাডোলোস্যান্স ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়, বাবা-মা সারাদিন ধরে কাজে নিয়োজিত থাকেন কিংবা কাজের কারণে দূরে থাকেন তাদের মধ্যে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

এ বিষয়ে “মনের বন্ধু”র সিইও তাওহিদা বলেন, “বাবাকে ছাড়া সন্তানের কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে শিশু প্রশ্ন তুললে বাবা কেন সঙ্গে নেই কিংবা কেন বাবাকে ছাড়া থাকতে হচ্ছে, তা খুবই শান্তভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হবে। সন্তানের সামনে অযথা তার বাবাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলা একদমই অনুচিত। এতে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে খুবই খারাপ প্রভাব পড়ে। বিষণ্নতা শিশুকে আরও গ্রাস করবে।”

এই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, “আমাদের জীবনে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষণ্নতা, উদ্বেগ অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। শিশুরাও এর শিকার হতে পারে। তবে একা মায়ের ধারণাটি আমদের সমাজে এখনো তেমন পরিচিত কিংবা গ্রহণযোগ্য নয়।”

বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই সচেতনতা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হলে যেন নিম্নবিত্তের মানুষও যাতে বিষয়টি থেকে বঞ্চিত না হন, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

   

About

Popular Links

x