কড়া সেন্সরশিপ ও সমাজের কট্টর মনোভাবের সঙ্গে লড়তে হয় পাকিস্তানের শিল্পীদের। চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও শৈল্পিক স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু খুব ধীরে হলেও অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।
২০১২ সালে চিত্রনির্মাতা শারমিন ওবায়েদ-চিনয় তার তথ্যচিত্রের জন্য অস্কার জেতেন। প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে এই পুরস্কার জেতেন তিনি। বছর পর, দ্বিতীয় অস্কার জেতেন তার ছবি “আ গার্ল ইন দ্য রিভার: দ্য প্রাইস অব ফরগিভনেস”-এর জন্য।
আপাতত শারমিন ব্যস্ত তার নতুন কাজ নিয়ে। ২০২৫ সালে মুক্তি পাবে তার পরিচালনায় “স্টার ওয়ার্স” সিরিজের ছবি। এই প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ মানুষ হিসেবে এই সিরিজ পরিচালনা করবেন তিনি।
আরেক তরুণ পরিচালক আসিম আব্বাসি ব্যস্ত বিখ্যাত কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ “দ্য ফেমাস ফাইভ”-এর একটি পর্ব নিয়ে।
অবশেষে মঞ্চ পাচ্ছে পাকিস্তানের সিনেমা
স্থানীয়দের মতে, পাকিস্তানের তরুণ নির্মাতাদের সাফল্যে নতুন করে শক্তি পাচ্ছে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প। কিন্তু কতটা বাস্তবিক এই ধারণা? এ বিষয়ে শারমিন বলেন, “বহু বছর ধরে নানা কারণে পাকিস্তানের পরিচালকরা দেশের বাঁধাধরা গতের বাইরে কাজ করতে পারছিলেন না। কিন্তু এখন নতুন চিত্রনির্মাতারা সাহস দেখাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হোক বা যুক্তরাজ্যে গিয়েও কাজ করার।”
তিনি যোগ করেন, “শুধু পরিচালকরাই নয়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও যাচ্ছেন (যেমন, ফাওয়াদ খান, মেহউইশ হাওয়াত, আহাদ রাজা মীর)। এটা প্রমাণ করে যে, তরুণ প্রজন্ম তাদের শিল্পের জন্য যেকোনো জায়গায় গিয়ে কাজ করতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানে সিনেমা বানানো কঠিন, বিনিয়োগ নেই, সরকারি সমর্থন নেই, কিন্তু সেন্সরশিপ আছে। চিত্র নির্মাতারা চান এমন গল্প বলতে যেগুলো সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই গল্পের খাতিরে দেশের বাইরে যেতে হলেও তারা যাবেন। আমার মতে, চিত্র নির্মাতারা সম্মান চান। তাদের শিল্প সম্মানের দাবীদার। আমার খুব আনন্দ হয় যখন দেখি আমার সহকর্মীরা সারা বিশ্বে সিনেমা বানাচ্ছেন।”
চমকে দেওয়া
পাকিস্তানি সিনেমার সাম্প্রতিক সাফল্য বিষয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শক ও ডিস্ট্রিবিউটর নাদিম মান্দভিওয়ালা মনে করেন, এতে করে দেশের পরিচালকরা অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। তিনি বলেন, “দ্য লেজেন্ড অব দ্য মওলা জাটের ব্যবসায়িক সাফল্যের পরেও অনেকে ভাবতে পারেননি যে বিশ্বের বক্স অফিসে আমরা এমন সাফল্য পাব। এটা অবশ্যই মনোবল বাড়ায়।”
কিন্তু দেশে সফল হতে আরও অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয় বলে জানান তিনি। তার মতে, “আরও বেশি ছবি বানাতে আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি তাতে ভূমিকা রাখবে। যে দশজন ছবি বানাবেন, তার মধ্যে একজন না একজন নজর কাড়বেনই।”
এ বিষয়ে শারমিনও একমত। তিনি বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন এই খাতে সার্বিক উন্নয়ন না আনতে পারলেও এতে করে নতুন প্রজন্মের পরিচালকরা নিজেদের পথ বেছে নেওয়ার একটা সুযোগ পাবেন। কিন্তু সার্বিকভাবে শিল্পের উন্নতি হবে না।”
স্থানীয় বক্স অফিসের হতাশাময় চিত্রের কথা বললেন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ আলি জেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধটা অনেকটা কঠিন। প্রথমে করোনাভাইরাস সংকট ধাক্কা দিলো। এছাড়া ভারতীয় ছবি এখানে দেখানো বন্ধ হওয়ায় দেশের একটি বড় মাল্টিপ্লেক্স সংস্থা তাদের সিনেমা হলের সংখ্যা গত চার বছরে ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। ২০২৪ পর্যন্ত কোনো বড় বাজেটের ছবির সম্ভাবনা নেই। একমাত্র হলিউডের ইংরেজি ছবির বদৌলতে আমাদের ব্যবসা টিকে আছে। এভাবে কতদিন চলবে জানি না।”
জীবন-মরণ লড়াই
মান্ডভিওয়ালা বলেন, “আমরা এখন বাঁচা-মরার লড়াই লড়ছি। যবে থেকে সরকার দেশে ভারতীয় ছবি মুক্তি পাওয়া বন্ধ করেছে, আমাদের এগোনোর কথা ভুলে বাঁচার কথা ভাবতে হচ্ছে। এর বিকল্প না পাওয়া গেলে এমনটাই চলবে। বিষয়টা হচ্ছে, পাকিস্তানিরা উর্দু বোঝেন, বলেন। ভারতীয় ছবির ভাষাও ওটাই। মানুষ বুঝতে পারে এই ছবি।”
অভিনেতা আদনান শাহ টিপু স্থানীয় ছবির মান নিয়ে সন্দিহান। তিনি বলেন, “আমি চিরকালই মনে করে এসেছি যে আমাদের শিল্পের মানের পেছনে বিনিয়োগ করা উচিত। প্রযোজনার মানের উন্নতি দরকার। আর সিনেমার টিকিটও এখন সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। বলুন তো, কে কিনবে সাড়ে সাতশো পাকিস্তানি রুপির (২৭০ বাংলাদেশি টাকা) টিকিট? জনসাধারণের সাধ্যের মধ্যে সিনেমাকে না আনতে পারলে কিছুই হবে না।”
বৈচিত্র্যের অভাবের এই অভিযোগ বিষয়ে মান্ডভিওয়ালা বলেন, “পুরনো দিনে আমরা শুনতাম যে শুধু একই ধরনের মানুষ সিনেমা দেখতে আসেন। ফলে, সিনেমায় বেশি করে গান-নাচ রাখতেই হতো। সেটা এখন পাল্টে গেছে। এখন শিক্ষিত সমাজও সিনেমা দেখে। আমাদের তুলনায় হলিউডে অন্য মাত্রার বৈচিত্র্য রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমার মতে, দেশের জনগণই ঠিক করা উচিত, তারা কী ধরনের সিনেমা দেখবে।”