রাজধানীর সড়কে চাপ কমাতে ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা সাবওয়ের চারটি রুটের একটি প্রাথমিক নকশা সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
সেতু কর্তৃপক্ষ ২০৭০ সালের মধ্যে ১১টি রুটসহ পুরো ঢাকা শহরকে পাতাল রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে।
সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী এবং ঢাকা সাবওয়ের প্রকল্প পরিচালক কাজী মুহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, “আমরা ১১টি রুটের মধ্যে চারটি রুটের প্রাথমিক নকশা সম্পন্ন করেছি।”
সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, প্রাথমিক চারটি রুট হলো- গাবতলি থেকে রূপগঞ্জের ভোলাবো পর্যন্ত ৩০.৫১ কিলোমিটার সাবওয়ে লাইন, নারায়ণগঞ্জের ঝিলমিল থেকে টঙ্গী মোড় পর্যন্ত ২৯.৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রুট, তৃতীয় রুটটি নারায়ণগঞ্জের কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুরের মধ্যে ১৯.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং চতুর্থ রুটটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং নারায়ণগঞ্জের মধ্যে ৪৭.৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে।
প্রস্তাবিত অন্য সাতটি রুট হলো- কেরানীগঞ্জ থেকে পূর্ব নন্দীপাড়া, বসুন্ধরা থেকে গাবতলি, হাজারীবাগ থেকে পূর্বাচল, শাহ কবির মাজার সড়ক থেকে সদরঘাট, তেঘোরিয়া বাজার থেকে বন্দর, টঙ্গী মোড় থেকে গাজীপুর এবং গাবতলি থেকে আমবাগান।
যদিও বিবিএ পাতাল রেল প্রকল্পের বিষয়ে আশাবাদী, তবে বিশেষজ্ঞরা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, দেশের সামাজিক, আর্থিক এবং ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে ঢাকা পাতাল রেল প্রকল্প নির্মাণের জন্য অনুকূল নয়।
প্রকল্পের খরচ
মুহম্মদ ফেরদৌস বলেন, “আমাদের অনুমান প্রতি কিলোমিটার সাবওয়ের নির্মাণ ব্যয় প্রায় ২৭৫ মিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। তবে, প্রথম ও দ্বিতীয় পাতাল রেল নির্মাণের জন্য বিবিএকে ৮ বিলিয়ন ডলার বা ৬৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকার বেশি খরচ করতে হবে।”
ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে সাবওয়ে নির্মাণের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করার জন্য স্পেন-ভিত্তিক পরামর্শদাতা সংস্থা টাইপসাকে নিয়োগ করেছে বিবিএ।
পরামর্শদাতা সংস্থাটি ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুসারে, ১১টি রুটসহ ২৩৮ কিলোমিটার প্রস্তাবিত ঢাকা পাতাল রেল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তিগত এবং আর্থিকভাবে সম্ভব।
তবে, ঢাকায় পাতাল রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণসহ সরকারকে ৮০ বিলিয়ন ডলার বা ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হবে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
বিবিএ আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি হোটেলে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে খসড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে মতামত জানাতে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে। তবে সেমিনারের আগে প্রাথমিক নকশা ও প্রতিবেদন শেয়ার করতে রাজি নন তারা।
সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, “সম্প্রতি পরামর্শদাতার কাছ থেকে সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের খসড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর, আমরা একটি অভ্যন্তরীণ বৈঠক করেছিলাম এবং মনে হচ্ছে ঢাকার জন্য সাবওয়েটি কার্যকর হবে। তবে আগামী সেমিনারের পর পাতাল রেল নেটওয়ার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে।”
স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে সম্মতি পাওয়ার পর ১১টি রুটের একটির বিস্তারিত নির্মাণ নকশার প্রস্তুতির বিষয়ে সরকারের কাছে যাবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
এর আগে, ২০১৭ সালে ঢাকায় এমন একটি যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সম্ভাবনা মূল্যায়ন করার জন্য “ঢাকা সিটিতে সাবওয়ে (আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো) নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন” শীর্ষক ৩১৫ কোটি বাজেটের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বিবিএ।
প্রধান সুবিধা
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, পাতাল রেল ট্রাফিক সমস্যা অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করবে।
অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, পাতাল রেলে ভ্রমণ খরচ কম, সুবিধাজনক, নিরাপদ এবং পরিবেশ বান্ধব, পাতাল রেল ভ্রমণ অন্যান্য পরিবহন পদ্ধতির তুলনায় অনেক দ্রুত এবং যানজট নিরসনেও সহায়ক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাইভেট কার ব্যবহার করার চেয়ে পাতাল রেল পরিবহন আরও লাভজনক। কারণ যাত্রীদের ভ্রমণের জন্য “সীমাহীন মাসিক পাস” দেওয়া হবে।
এটি আরও জানিয়েছে, পাতাল রেল ভ্রমণ পরিবেশের জন্য উপকারী। এটি পরিবেশগতভাবে অটোমোবাইল ভ্রমণের চেয়ে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণই শুধু নয় বরং পাবলিক বাস সিস্টেমের তুলনায়ও ভালো।কারণ পাতাল রেল বাতাসে ক্ষতিকারক ধোঁয়া নির্গত করে না। এটি ঢাকার মতো জনবহুল শহরে জনসাধারণের জন্য মসৃণ যান চলাচল নিশ্চিত করবে।
প্রতিবন্ধকতা
যদিও সেতু কর্তৃপক্ষ পাতাল রেল প্রকল্প নিয়ে আশাবাদী, তবে অন্য বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন মতামত দিয়েছেন।
দেশের অনেক নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ গত বছর একটি কর্মশালায় পাতাল রেল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য কিছু বড় চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছিলেন।
প্রথমটি হলো তহবিলের অনুপলব্ধতা।
তারা জানান, সরকার এখনও ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড প্রকল্পের জন্য তহবিল পরিচালনা করতে পারেনি, যা অন্য যেকোনো প্রকল্পের চেয়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারকে প্রকল্পটি চালাতে ভর্তুকি হিসেবে একটি বড় অংক ব্যয় করতে হবে। কারণ পাতাল রেলের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অন্য যেকোনো পরিবহনের চেয়ে বেশি।
এছাড়াও, সরকারকে পাতাল রেল চালানোর জন্য নির্বিঘ্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কের জলাবদ্ধতা পুরোপুরি অপসারণ করতে হবে বলেও জানান তারা।
“পাতাল রেল ঢাকার যোগাযোগ সমস্যার উন্নতিতে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তবে অন্যান্য পরিবহন মাধ্যমের সঙ্গে একে ওভারল্যাপ করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত,” বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাদিউজ্জামান বলেছেন।
“পাতাল রেল নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনা ব্যয় নিয়মিত পরিবহনের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। পাতাল রেল টানেলটি মাটির ৩০ মিটার গভীরতায় নির্মিত হবে,” তিনি যোগ করেছেন।
“পাতাল রেল নির্মাণের অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু প্রকৌশল সমাধানও আছে। এ ধরনের প্রকল্প নির্মাণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে,” বলেন বিবিএ'র প্রধান প্রকৌশলী কাজী মুহাম্মদ ফেরদৌস।