উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় “রিমাল” উত্তর দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া সর্বশেষ ৯ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “রিমাল” আজ (২৬ মে) সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৬০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে খুলনার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েছেন উপকূলের মানুষ। কারণ, উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে মোট ২,০০৬ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ।
উপকূলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলের ৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বাঁধের ওসব অংশ ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট প্লাবন মোকাবিলার সক্ষমতা রাখে না। এমনকি আগামী বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এছাড়া ওই এলাকার প্রায় ৬০০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে ঘূর্ণিঝড় “রিমাল” নিয়ে উপকূলবাসী দুশ্চিন্তায় আছেন।
এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়রা উপজেলা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালি এলাকায় এক কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়া এলাকায় দুই কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় তিন কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এসব এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি বাড়লে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের দাবি, উপকূলীয় ওই তিন জেলার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ অনেকটাই সংস্কার করা হয়েছে। আরও কিছু এলাকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশকিছু এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। বাঁধের যেসব অংশ ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো পর্যবেক্ষণে রেখেছে পাউবো।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে ধীরগতিতে। ১,০২৩ কোটি টাকার “সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নম্বর-১৫ পুনর্বাসন” শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০২১ সালে এবং ২০২২ সালে ১,১৭২ কোটি ৩১ লাখ টাকায় “কয়রা উপজেলার পোল্ডার নম্বর-১৪/১ পুনর্বাসন” শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়। প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি বেশকিছু ছোট প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে “সাতক্ষীরার পোল্ডার নম্বর-১৫ পুনর্বাসন” প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুন মাসে শেষ হবে। অথচ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজের অগ্রগতি মাত্র ২০%। “কয়রা উপজেলার পোল্ডার নম্বর-১৪/১ পুনর্বাসন” শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজের অগ্রগতি ৫%-এর কম।
এ বিষয়ে কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি আমাদের বহুদিনের। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের জানালেও তারা শুধু আশ্বাস দেন। পরিকল্পিত ও স্থায়ী বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতি বছর ভাঙন দেখা দেয়। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলতি দায়ী। আবার যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো শেষ করা হচ্ছে না।”
কয়ড়ার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুস সালাম খান বলেন, “এতকাল যত দুর্যোগ এসেছে, অধিকাংশই মে মাসে। এজন্য মে মাস এলেই আতঙ্কে থাকেন উপকূলবাসী। ঘূর্ণিঝড় না হলেও এ সময় নদীর পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে। প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সময়মতও মেরামতের উদ্যোগ নিলে কম খরচ ও কম সময়ের মধ্যে মানসম্মত কাজ করা সম্ভব। কিন্তু বর্ষার আগ মুহূর্তে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে পাউবো কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয়। এতে একদিকে খরচ বাড়ে, অন্যদিকে তড়িঘড়িতে কাজ হয় নিম্নমানের। ফলে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকার ঝুঁকি কমছে না, বরং বাড়ছে।”
উপকূলীয় বেশ কিছু এলাকায় বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পাউবো খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম। তিনি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “বিভিন্ন পোল্ডারের বাঁধ পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক স্থানে সংস্কারকাজ শুরু করা হয়েছে। বাকি কাজও দ্রুত শুরু করা হবে। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।”
স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় “আইলা” বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে এবং ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে। টানা ১৫ ঘণ্টার ঝড় ও ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ এলাকায় দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম লবণ পানিতে তলিয়ে যায়। বহু কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের ভেসে গিয়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নিহত হন শিশুসহ ৭৩ জন নারী-পুরুষ। হাজার হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। উপকূলজুড়ে অর্থনীতিতে পড়ে বিরূপ প্রভাব।
আইলার সেই ক্ষত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ৪ মে “ফণী”, ওই বছরের ১০ নভেম্বর “বুলবুল”, ২০২০ সালের ২০ মে “আম্পান”, ২০২১ সালে ২৬ মে “ইয়াস”, ২০২২ সালের ১২ মে “অশনি” এবং ২০২৩ সালের ১৪ মে “মোখা” আঘাত হানে। এতে আরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বশেষ উপকূলে ঘূর্ণিঝড় “রিমালের” আঘাত হানার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে আতঙ্কে আছেন স্থানীয় লোকজন।