পরিবেশগত বিষয়াদি বিবেচনায় রেখে পরিবেশ বান্ধব “আধা নিবিড়” চিংড়ি চাষ হচ্ছে উপকূলীয় জেলায়। গত ৮ বছর ধরে এ চাষ চললেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। ফলে এ চাষ বিস্তার লাভ করেনি। তবে, ধৈর্য ধরে এ চাষে টিকে থাকায় সফলতার মুখ দেখছেন মো. আনারুল ইসলাম।
৮ বছর আগে সাতক্ষীরায় ১১ জন আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ শুরু করেন। কিন্তু সরে গেছেন অনেকেই। ধৈর্য নিয়ে থাকায় ২০২৪ সালে আনারুল আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ থেকে সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা আয় করেন। তিনি খামার পরিচালনা করছেন দেবহাটায়। চিংড়ি চাষে ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আনারুল বলেন, “চিংড়ি চাষে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের পরও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘেরের পানির তাপমাত্রায় হঠাৎ পরিবর্তন আসে। যা চাষীদের ক্ষতি করে।”
তিনি জানান, চিংড়ি চাষে সরকার অনুমোদিত বৈধ উপকরণ ব্যবহার করে থাকেন। চিংড়ি উৎপাদনে তিনি কখনো গ্রোথ হরমোন বা এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন না। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে তিনি সর্বদা ভালো কোম্পানির মানসম্মত ফিড ব্যবহার করেন। তিনি ২০২৪ উৎপাদন বছরে বাগদা চাষে অভাবনীয় সফলতা পেয়েছেন। আনারুল দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের রাঙ্গাশিসা গ্রামের আহছানিয়া ফিস বাগদা খামার পরিচালনা করেন।
আনারুলের বাড়ি দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের রাঙ্গাশিসা গ্রামে। আহছানিয়া ফিস খামার নামে বাগদা চিংড়ি খামারের কার্যক্রমের আওতায় তার খামারে রয়েছে ১২টি পুকুর। খামারের আয়তন ৯ হেক্টর। যার জলায়তন ৪.৮০ হেক্টর। এটি একটি আধা নিবিড় বাগদা চিংড়ি খামার।
আনারুল জানান, ২০২৪ উৎপাদন বছরে খামারের ৪.৮০ হেক্টর জলাশয়ের ১২টি পুকুরে ৬১.২৫ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন করেন। হেক্টর প্রতি ১২.৭৬ মে. টন বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। প্রতি হেক্টরে ব্যয় হয় ৭০.৮৩ লাখ টাকা, আয় করেছেন ১০৯. লাখ টাকা। ফলে হেক্টর প্রতি তিনি লাভ করেছেন ৩৮.৫৪ লাখ টাকা।
মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, খামারের খাদ্য নমুনায়ন করে এ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো গ্রোথ হরমোন বা এন্টিবায়োটিক পাওয়া যায়নি। চিংড়ি নমুনায়ন করেও এ পর্যন্ত কোনো গ্রোথ হরমোন বা এন্টিবায়োটিক/কীটনাশক/নিষিদ্ধ কোন কেমিক্যাল পাওয়া যায়নি। ঘের প্রস্তুতকালীন পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে বা কোনো নিষিদ্ধ কোন কেমিক্যাল তিনি ব্যবহার করেননি।
দেবহাটা উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. আবুবকর সিদ্দিক জানান, উপজেলায় বর্তমান ৩টি আধা নিবিড় বাগদা খামার রয়েছে। আধা নিবিড় খামার বাড়ানোর জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কারণ, সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে হেক্টর প্রতি মাত্র ৩৫০ কেজি বাগদা উৎপাদিত হয়, সেখানে আধানিবিড় পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কেজি বাগদা উৎপাদন সম্ভব। আনারুল ২০২৪ সালে সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা লাভ করেছেন আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ করে। যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সাড়া জাগানো খবর। এ ধরনের আধা নিবিড় পদ্ধতি অনুসরন করে আশপাশের অনেক বাগদা চিংড়ি চাষি বাগদা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। ফলে আধা নিবিড় বাগদা চিংড়ির খামার সম্প্রসারিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ প্রক্রিয়ায় অনেক বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যা মেনে চাষ করতে হয়। আর সাধারণ পদ্ধতির চিংড়ি চাষে এ ধরনের কোনোপ্রক্রিয়া নেই।
দেবহাটা উপজেলা মৎস্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেবহাটা উপজেলায় ৪৫০ হেক্টর আয়তনের ৭৭৫টি গলদা ঘের রয়েছে। যার উৎপাদন ৮৮৯ মেট্রিক টন ও ৮৮৯৩ হেক্টর আয়তনের ৭,৪৬৯টি বাগদা চিংড়ি ঘের রয়েছে। যার উৎপাদন ৩৩৯০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে মাত্র ১১ হেক্টর আয়তনের ৩টি আধা নিবিড় বাগদা খামার রয়েছে। যার উৎপাদন ১৪৩ মেট্রিক টন। দেবহাটা উপজেলায় মাছের ৪,৯৩৩ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে ১০,৪৮১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ ৫,৫৪৮ মেট্রিক টন মাছ বেশি উৎপাদিত হয়। মাছ ও চিংড়ি চাষে সমৃদ্ধ এ উপজেলা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিতেও ভূমিকা রাখছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম জানান, এ জেলায় ৫৪ হাজার ঘেরের ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে ২৬ হাজার মেট্রিক টন বাগদা ও ১১ হাজার ঘেরের ৯ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ হাজার মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। এগুলো সাধারণ ঘের। পাশাপাশি ১১টি ঘেরে আধা নিবিড় পদ্ধতির চিংড়ি চাষ হয়। সেখানে হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ ৭ মেট্রিক টন ও সর্বনিম্ন ৩ মেট্রিক টন পর্যন্ত উৎপাদন হয়। কিন্তু এ চাষ পদ্ধতির শুরুতে খরচের পরিমাণ বেশি। আবার সাধারণ ঘেরের চেয়ে আধা নিবিড় পদ্ধতির চাষে উৎপাদন ৩-৪ গুণ বেশি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আধা নিবিড় চিংড়ি চাষেও পড়ছে। হঠাৎ বৃষ্টি, দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে গভীর ঘেরের পানির তাপমাত্রায় মারাত্মক পরিবর্তন ঘটে। যা চিংড়ির জন্য ক্ষতি করে। এ কারণে আধা নিবিড় চিংড়ি চাষের বিস্তার নেই। খরচ বাড়লেও উৎপাদন অনেক বেশি।
তিনি বলেন, “আধা নিবিড় চিংড়ি চাষের ঘেরের গভীরতা ৫ ফিট করার কথা বললেও অনেকেই খরচের কারণে ৩ ফিট করে রাখেন। যা চাতুর্যময়। এ কারণে তারা ক্ষতির মুখে পরেন। আবার অনাবৃষ্টির পর তাপ বেড়ে পানির তাপমাত্রায় পরিবর্তন হয়, অনেক বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় হঠাৎ বৃষ্টিতে আবার পানির তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত কমে যায়। পানিতে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন চিংড়ির জন্য হুমকি।”
আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ প্রক্রিয়া
- পানির গভীরতা ৫ ফিট করতে হয়।
- পুকুরের মাঝখানে কিছুটা গর্ত করে ফিস টয়লেট করতে হয়।
- পুকুরের চারপাশে ব্লু নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হয়।
- মাইক্রো নেট দিয়ে ছেকে পুকুরে পানি প্রবেশ করাতে হয়।
- পানিতে লবনের মাত্রা ১০-২০ পিপিটি হতে হয়।
- প্রবেশকৃত পানি প্রতি শতাংশের জন্য প্রতি ফিট গভীরতার জন্য ৮০০ গ্রাম হারে ব্লিচিং করাতে হয়।
- প্রিবায়োটিক ও প্রবায়োটিক প্রয়োগ করে চিংড়ির প্রাথমিক খাদ্য ফাইটোপ্লাংটন ও জুপ্লাংটন তৈরি করতে হয়।
- রোগ মুক্ত এসপিএফ পিএল(রেনু পোনা) মজুদ করতে হয়।
- উচ্চ ঘনত্বে অর্থাৎ প্রতি শতাংশে ৬০০-১০০০ টি পিএল মজুদ করা হয়। এ জন্য প্রয়োজন অনুসারে এরেটর স্থাপন করতে হয়।
- প্রয়োজন অনুসারে ৭-১০ দিন পরপর মিনারেলস প্রয়োগ করতে হয়।
- পানির পিএইচ ৭.৮-৮.১ এর মধ্যে ও অক্সিজেন ৫-৮ পিপিএম এর মধ্যে নিয়ন্ত্রন করতে হয়।
- নিয়মিত উচ্চ মান ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দিতে হয়। খাবার কেমন খাচ্ছে এ জন্য ফিড ট্রে ব্যবহার করতে হয়।
- নিয়মিত চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়।