২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় প্রতিদিন এমন একাধিক ঘটনা ঘটে চলেছে যে ঠিক আগের দিনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই পরের দিন তার চেয়েও অত্যাশ্চর্য ঘটনা টিভির পর্দায় দেখতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সম্প্রতি দুটি ঘটনার রেশ দিন কয়েক অতিবাহিত করার সুযোগ পেয়েছে। একটি হলো, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরূল হুদাকে শারীরীক এবং মানসিক নির্যাতনের পর পুলিশে সোপর্দ, অন্যটি হলো লালমনিরহাটে কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে পিতা এবং পুত্রকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের পর লালমনিরহাট সদর থানায় সোপর্দের ঘটনা। বাংলাদেশে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা লোকেরা কিছু ক্ষেত্রে তাদের অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে আইনিভাবে শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন, কেউ কেউ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন কিন্তু জনতার হাতে নাকাল হয়েছেন, শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে এমন ঘটনা বিরল। ৫ আগস্টের পরে এটা একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক নির্দোষ মানুষও হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। যেটাকে মব জাস্টিস, মব ভায়োলেন্স নানা পরিভাষায় উপস্থাপন এবং আলোচনা, সমালোচনা করা হচ্ছে। তাই অনেকেই দেশকে এখন মগের মুল্লুক এবং বর্তমান সরকারকে বলছেন “মবের সরকার”। কিন্তু কথিত ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের অভিযোগে উন্মত্ত জনতার কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তি, তার পরিবার এমনকি গোটা পাড়ার ওপর, তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা বাংলাদেশ বিরল নয়; বরং চলমান বিষয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামলীগ এর ১৫/১৬ বছরের শাসনামলে এবং বর্তমান কথিত বৈষম্যবিরোধী জামানায় অন্তর্বতীকালীন সরকারের এই স্বল্পমেয়াদেও এই ঘটনা চলমান রয়েছে এবং এ ব্যাপারে সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাতেও কোনো পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বরং এই সরকারের আমলে সেনাবাহিনী সার্বক্ষণিক মাঠে থাকায় ঘটনাগুলোতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে তারা শক্ত হাতে তারা প্রতিহত করবে বলে যে প্রত্যাশা জনগণের একাংশের মনে ছিল, সেখানেও দারুণভাবে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। আমি এটাকে অনুভুতিতে আঘাতের রাজনীতি কেন বলতে চাই, সেইটা পরিস্কার করা জরুরি। মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ হয় বিমূঢ় হয়ে পড়েন, নইলে যিনি বা যার দ্বারা তার অনুভূতি আহত হয়েছে তিনি বা তার উপর প্রতিশোধ নিতে চান। কিন্তু আমরা দেখেছি, প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রে উন্মত্ত জনতা কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শারীরীকভাবে আক্রমণের পাশাপাশি তার আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশিদের বাড়িঘরে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং লুটপাটের ঘটনাও ঘটিয়েছে। তাহলে কি এগুলি পরিকল্পিত কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এই প্রশ্নের জবাব কিন্ত পূর্বের ঘটনাগুলোর খোঁজ খবর যারা রেখেছেন, তাদের অজানা নয়। আমি নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছি, আচ্ছা এইগুলো যদি পরিকল্পিত কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে তাহলে তো ধন্যাঢ্য ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকেই এই উন্মত্ত জনতা টার্গেট করতে পারতেন। কিন্তু গত ১৫/১৬ বছরে যতগুলি আলোচিত ঘটনা ঘটেছে, হিসাব করলে দেখা যাবে বেশিরভাগক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তগণ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিম্ন আয়ের মানুষ। এখানে ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর কৌশল কাজ করছে কি’না কিংবা এই প্রক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের সাহস বৃদ্ধি করেছেন কি’না সেটা অবশ্যই আমলে নেওয়া জরুরি।
এখন কথা হলো এগুলোর মধ্যে রাজনীতিটা কোথায়? রাজনীতি হলো, এই যে সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিষয়টাকে আমলে নিচ্ছেন না, সেখানে। রাজনীতিটা হলো, একটি ঘটনারও যথাযথ প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি এবং প্রকাশ্যে মানুষের ওপর হামলা, বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মত অপ্রাধের সঙ্গে জড়িত একজন ব্যক্তিরও শাস্তি হয়নি। উল্টো ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা পরবারের আইনি জটিলতায় হেনস্তার শিকার হয়েছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের যারা কর্ণধার তারা কি এগুলো জানেন না কিংবা যারা ক্ষমতার বাইরে আছেন তাদের কাছেও এগুলো খুব অজানা বিষয়? তাহলে কেন ক্ষমতার মসনদে বসে তারা সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন না? আর যারা ক্ষমতার বাইরে আছেন, তারাও কেন এগুলোর বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেন না? পারছেন না কারণ, যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা কথিত সংখ্যাগুরুদের একাংশের উন্মত্ততাকে সত্যিকার অর্থে অনুভূতি বলে বিবেচনা করেন তাদের নিজস্ব স্বার্থে। আর অন্যরা মনে করেছেন, এই ইস্যুগুলোতে ন্যায্য কথা বলতে গেলে তাদের ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে। এটাই হলো রাজনীতি। সম্প্রতি লালমনিরহাটের ঘটনায় আমাদের বুদ্ধিজীবী এবং কথিত বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ বলছেন, এই ঘটনা নাকি বিজেপি’র পাতানো ফাঁদ আবার কেউ কেউ বলছেন, এই ঘটনা “র” ঘটিয়েছে। রাজনীতিটা হলো এখানে। সাম্প্রতিক দেশীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যদি ধরেও নেয় যে এই এই ঘটনায় বহিঃশক্তির ইন্ধন রয়েছে। তাহলে তো দেশের মধ্যে এই চক্রান্ত যাতে সফল না হয়, সেজন্য প্রথম গ্রেপ্তারর হওয়ার কথা যারা কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তার ছেলের ওপর হামলা করলেন তাদের কিন্তু আমরা কি দেখলাম? পূর্বের নজির অনুসরণ করে আটক করা হল ভূক্তভগী ব্যক্তিদ্বয়কে এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থানীয়ভাবে যিনি কর্ণধার, তিনি প্রকাশ্যে উন্মত্ত জনতাকে আশ্বাস দিচ্ছেন, শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতিত আটক ব্যক্তিদ্বয়কে এমন মামলা দেবেন যাতে তাদের হয় যাবতজীবন, নয় ফাঁসি হয়। তিনি উন্মত্ত জনতার কথিত অনুভূতির সাথে নিজের আবেগ মিশিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখলনে থানা ভবনে ছাদের নিচে দাড়িয়েই। তিনি চাকুরিবিধি এবং প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করেছেন, তিনি অপরাধ করেছেন কিন্তু না বিভাগীয়ভাবে না রাষ্ট্রযন্ত্রের তরফ থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। রাজনীতিটা এখানেই। একে বলে রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছার অভাব কিংবা অপরাজনীতি, যেটা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি হল, এই অপরাজনৈতিক চর্চা আমরা সমাজে এবং রাষ্ট্রে টিকিয়ে রাখতে চাই, ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেকে ফায়দা লুটতে চাই। রাজনীতি হলো স্বার্থের জন্য, ফায়দা লোটার জন্য দেশের একজন নাগরিককে, একটা গোষ্ঠীকে, একটি ধর্মের অনুসারী ব্যতীত অন্য ধর্মের অনুসারীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করা। সমাজ এবং রাষ্ট্রে এই প্রবণতা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়; তাই বলা যেতে পারে অনুভূতিতে আঘাতের রাজনীতি চলছেই, চলবে! এর শেষ কোথায় আমরা জানিনা।